পৃষ্ঠাসমূহ

Sunday, November 26, 2017

১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস : আমাদের ভাবনা



আবুল কাসেম হায়দার : আমাদের সবচেয়ে প্রিয় দিবসটি হচ্ছে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস। এই দিনে ১৯৭১ সালে আমরা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী থেকে যুদ্ধে জয় লাভ করে বিজয় অর্জন করেছি। তাই এদিন আমাদের সকলের অতি প্রিয়, অতি আনন্দের দিন। প্রতি বছর এই দিনটি ঘুরে ঘুরে আমাদের মাঝে হাজির হয়। হাজারও রকম অনুষ্ঠানের মাধ্যমে আমরা বিজয় দিবস পালন করি। বিজয় দিবসের এই দিনে তাই নানা কিছু আমাদের হৃদয়ে ভেসে উঠে। প্রশ্ন জাগে কিসের বিজয়? কেমন করে আমাদের এই বিজয় অর্জিত হলো? কে আমাদের শত্রু? কে আমাদের বন্ধু বা মিত্র? এই দিনটিকে ঘিরে সকল প্রশ্নর জন্ম হয়।
১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান ও ভারতবর্ষ নামে দুটি দেশের জন্ম হয়। ঐদিন পর্যন্ত বৃটিশ আমাদের শাসন করে। বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরাজয়ের পর বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়। দীর্ঘ প্রায় দুই শত বছর ব্রিটিশ বেনিয়া আমাদের ভারতবর্ষকে শাসন-শোষণ করে। ১৯৪৭ সালের পর থেকে পাকিস্তানের অংশ পূর্ব পাকিস্তান যা আজকের বাংলাদেশ নানাভাবে পাকিস্তানী শাসক দল কর্তৃক শোষিত হচ্ছিল। অত্যাচার, অনাচার, জুলুম, নির্যাতনের বিরুদ্ধে, অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য, বাংলা ভাষার জন্য আমাদের ১৯৪৭ সালের পর আন্দোলন শুরু হয়। প্রথমে এই আন্দোলন ছিল মাতৃভাষার রক্ষার আন্দোলন। যখন জিন্নাহ বললেন পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু, তক্ষণি প্রতিবাদ না না, বাংলা ও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। ১৯৪৮ সালে জিন্নাহ পূর্ব পাকিস্তান সফরের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার জন্য স্মারকলিপি দেয়। তখন থেকে রাষ্ট্রভাষা বাংলার আন্দোলন শুরু। ১৯৫২ সালে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলনে সালাম, রফিক, জব্বার, প্রাণ দিয়ে প্রমাণ করেছেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। আজ বিশ্বজুড়ে ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস। ঐ দিনের স্মরণে জাতিসংঘ আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসাবে ঘোষণা করা হয়েছে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন পর ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান বিরোধী গণঅভ্যুত্থান আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও এক ধাপ এগিয়ে নেয়। ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান পর ৭০ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসে। নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা পূর্ব বাংলার মানুষ মনেপ্রাণে গ্রহণ করে। সারা পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠিতা অর্জন করে। কাজেই স্বাভাবিকভাবে বঙ্গবন্ধু সরকার গঠন করে পাকিস্তান শাসন করবেন।  কিন্তু সেনা শাসক ইয়াহিয়া খান তা করতে দিলেন না। বঙ্গবন্ধু আন্দোলন অব্যাহত রাখলেন। ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ভুট্টোর সঙ্গে আতাত করে ইয়াহিয়া খান পূর্ব বাংলার উপর ২৫ মার্চ কালো রাত্রিতে হত্যা-নির্যাতন শুরু করে দেয়। কিন্তু ঐ দিনের পূর্বে ৭ মার্চ ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু রেসকোর্স ময়দানে তার অমর ভাষণে জাতিকে নির্দেশনা দিয়ে স্বাধীনতার পথকে সুগম করলেন। তাই ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ আন্দোলনকামী বাংলার মানুষের উপর লেলিয়ে দেয়া পাকিস্তানী বাহিনী এক হত্যাযজ্ঞ শুরু করে। তখন থেকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতার যুদ্ধ।
১৯৭১ সালে ২৫ মার্চের পর থেকে মাত্র ৯ মাসে বাংলার দামাল ছেলেরা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীনতার দুয়ারে নিয়ে উপনীত হয়। মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ভারতীয় বাহিনীর সার্বিক সহযোগিতায় আমাদের মুক্তি সংগ্রাম সফলতা লাভ করে। লক্ষ শহীদের প্রাণের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে আমরা আমাদের বিজয় পতাকা ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হই। তাই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস, মুক্তির দিবস। বিজয় দিবস আসলে আমাদের ভাবনা মনের হৃদয়ে উঁকি দিতে থাকে। কেন আমরা যুদ্ধ করেছি? কি জন্য লক্ষ লক্ষ তরুণ জীবন দিল? চেয়েছি কি? আমরা পেয়েছি কি? আমাদের যুদ্ধ, সংগ্রাম, ত্যাগ অনেকগুলো কারণকে নিয়ে সংঘটিত হয়েছিল।
গণতন্ত্রের জন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ : ১৯৭০ সালে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পরও পাকিস্তানী বাহিনী গণতন্ত্রকে ধূলিসাৎ করে দিয়ে স্বৈরশাসন কায়েম করে। তার বিরুদ্ধে ছিল আমাদের প্রতিবাদ, সংগ্রাম এবং সর্ব শেষে যুদ্ধ। গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার জন্য আমরা যুদ্ধ করেছিলাম। তার বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতা আসে। একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্র আমরা লাভ করলাম। গণতন্ত্র মুক্তি পেল। আজ আমাদের দেশ স্বধীন আমাদের স্বাধীন সংসদ রয়েছে। আমাদের নির্বাচিত জাতীয় সংসদ কর্তৃক নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী আমাদের দেশ পরিচালনা করছেন। আমাদের একটি স্বাধীন সেনাবাহিনী রয়েছে। আমাদের জাতীয় সত্তা আলাদা। আমরা বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারি। দেশ আমাদের কর্তৃক স্বাধীনভাবে পরিচালিত হচ্ছে। কিন্তু প্রকৃত বাকস্বাধীনতা গণতন্ত্র কি সর্বস্তরে আশা আকাক্সক্ষা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছি? বিজয় দিবসে এই সকল ভাবনা আমাদের মনকে বারবার দোলা দেয়।
অর্থনৈতিক মুক্তি : অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমরা ১৯৭১ সালে যুদ্ধ করেছি। অর্থনেতিকভাবে বিশ্বের দরবারে আমরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারব বলেই আমাদের মুক্তি। কিন্তু ১৯৪৭ সালের পর অর্থনৈতিকভাবে আমরা স্বাধীন ছিলাম না। অর্থনৈতিক বৈষম্য আমাদেরকে মুক্তিযুদ্ধে অনুপ্রাণিত করে। বৈষম্যের ফলে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পিছিয়ে পড়ে। ১৯৫০ দশকে পূর্ব পাকিস্তানে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মোট বিনিয়োগ শতকরা ২১ ভাগ থেকে ২৬ ভাগ। ১৯৬০ এ তা বৃদ্ধি পেয়ে হয় শতকরা ৩২ থেকে ৩৬ ভাগ। রেভিনিউ খাতে ওই সময় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় হয় মোট ২৫৪ কোটি টাকা কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয় ৮৯৮ কোটি টাকা। এইভাবে অর্থনৈতিক বৈষম্যের ফলে অত্র এলাকার মানুষ দরিদ্র থেকে দরিদ্র হচ্ছিল। নানাভাবে শোষণের ফলে আমাদের ভাগ্যের পরিবর্তন ছিল খুবই সীমিত। তাই আন্দোলন, তাই সর্ব শেষে মুক্তিযুদ্ধ। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য আমাদের যুদ্ধ। কিন্তু বর্তমানে ধনী দরিদ্রের ব্যবধান অনেক। তখন ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এখন ৪০ শতাংশ মানুষ নিরক্ষর, লেখাপড়া জানে না। তাই স্বাধীনতা ৪৩ বছরে এসে আমাদের মনে করে দেয়। আমাদের আরও উন্নত হতে হবে। আরও বেশি অর্থনৈতিক উন্নতি সর্বস্তরের জনগণের মধ্যে আনতে হবে। যদিও আমরা এখন নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছি। শীঘ্রই আমাদের উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছাতে হবে। সরকার ২০২১ সালের মধ্যে উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশ ও ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন।
সামাজিক কাঠামো ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি ঃ স্বাধীনতার পর থেকে তথা ১৯৪৭ সালের পর থেকে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তান দুইটি আলাদা সমাজ কাঠামোর গড়ে উঠে। পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতি পূর্ব পাকিস্তানের সংস্কৃতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। শুধু মুসলিম তথা ইসলামের একটি লেবাস ব্যবহার করা হয়েছিল। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের শুধু সামাজিক কাঠামো স্বতন্ত্র ছিল তাই নয়, রাজনৈতিক সংস্কৃতিও ছিল ভিন্ন ইসলামী ঐতিহ্য এবং হিন্দু বৌদ্ধ সংস্কৃতির গভীর প্রভাবে বাঙালি সংস্কৃতি গড়ে উঠে ইসলামের নিবারণ অথচ অনমনীয় নীতি শুদ্ধ আদলে এবং হিন্দু ধর্মের উদার ও গ্রহণযোগ্যতার তীর ঘেঁষে। পশ্চিম পাকিস্তানের সংস্কৃতি ছিল অনেকটা গোঁড়া ও একাত্মবাদী। রাজনৈতিক ও সামাজিক এই পার্থক্য দুই পাকিস্তানকে আলাদা করতে অনুপ্রেরণা জোগায়। সর্বোপরি হত্যা, গুম, নির্বিচারে গণহত্যা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে আসে। অতি অল্প সময়ে মাত্র ৯ মাসে আমরা আমাদের মুক্তির স্থানে পৌঁছে গেলাম। আজ আমরা এক জাতি, একই সংস্কৃতিতে জীবনযাপন করি। কিন্তু তবুও আমাদের মধ্যে পার্থক্য বিরাজমান। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান এই চার জাতির পর আমাদের মধ্যে বয়ে নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী ও উপজাতীয় জনগোষ্ঠী।
স্বাধীনতা আন্দোলন এবং স্বাধীন বাংলাদেশ ঃ বিজয় দিবসে আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস মনে করে দেয়। ছয় দফা কর্মসূচিভিত্তিক স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন প্রথম থেকেই ছিল অত্যন্ত গতিশীল এবং জনসমর্থনপুষ্ট। ছয় দফা বাঙালির হৃদয় মনে এমনভাবে স্থাপিত হয়েছিল যেন এক জাতি, এক দেশ, এক নেতা এক আন্দোলন। তাই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ পরিষদের ১৬২ আসনের মধ্যে ১৬০টি আসন লাভ করে বিজয় অর্জন করে। এবং মহিলাদের ৭টি আসনও আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে এক রেকর্ড স্থাপন করে। নির্বাচনের এই ফলাফল ছিল আশাতীত এবং নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ প্রত্যাশা করেছিল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় সমাসীন হবে। কিন্তু পাকিস্তনী শাসনকারী এলিটবৃন্দ আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাসীন না করার ক্ষেত্রে ছিল অনমনীয়। এমনকি বাঙালি আধিপত্যে পাকিস্তানকে রক্ষা করতে তারা রাজি ছিল না। ৩ মার্চ ১৯৭১ সালে নির্বাচনের ফলাফল স্থগিত রেখে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১ মার্চের ঘোষণা থেকে ছিল এক ক্রান্তিলগ্ন। এমনিতে তাই ছয় দফা দাবি অচিরে রূপ নিল একদফা দাবিতে, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার এক দফা দাবিতে। আজকের বিজয় দিবসে এই সকল ইতিহাস আমাদের মনে করে দেয় গণতন্ত্রের সীমা রেখাকে। আমরা কি সেই গণতন্ত্রের চর্চার মর্যাদা দিতে পেরেছি! দেশে বিদেশে কি আমাদের সেই মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছে। না পাইনি। তাই আমাদের আরও অনেক বেশি দূর পাড়ি দিতে হবে। গণতন্ত্রের জন্য আমাদের সংগ্রামকে আরও বেশি বলীয়ান করতে হবে। গণতন্ত্রকে সম্মান করতে শিখতে হবে, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জন্য দলমত নির্বিশেষে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। আজকের বিজয় দিবস হোক আমাদের সেই স্বপ্ন পূরণের দিবস।
বিজয় দিবস ও দারিদ্র্য : আমরা আমাদের বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। কিন্তু দারিদ্র্র্যকে আমরা জয় করতে পারিনি। আমাদের এখনকার সংগ্রাম হতে সমান, দেশ দারিদ্র্য হঠাও আন্দোলন। দেশের এখন ৪০ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যের নিচে রয়েছে। প্রায় ৩৫ শতাংশ মানুষ শিক্ষার আরো থেকে বঞ্চিত।  ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদেরকে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান অনেক অনেক কমিয়ে আনতে হবে। উপায় কি? কিভাবে আমরা আমাদের দরিদ্রতার সীমাতে কমিয়ে আনতে পারি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের মূল অস্ত্র ছিল আমরা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মুক্তি চাই। রাজনৈতিক মুক্তি আমাদের এসেছে। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তি এখনও পুরোপুরি আমরা লাভ করতে পারি নাই। সরকার দারিদ্র্য দূর করার জন্য নানা কর্মসূচি গ্রহণ করে যাচ্ছেন। একটি খামার একটি বাড়ি প্রকল্প কয়েক বছর ধরে চালু হয়েছে। কিছুটা সুফল কিছু লোকে লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। প্রতিটি গ্রামে আমাদের এখনও প্রাইমারী স্কুল নাই। সরকার সকল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষার আওতায় আনার জন্য চেষ্টা করছেন। কিন্তু এখনও তা কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেনি।
বিজয় দিবসে দুর্নীতিকে ‘না’ : আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪৫ বছর শেষে এখনও আমরা দুর্নীতিকে ডুবে রয়েছে।  আমাদের সকল অর্জন দুর্নীতি নামক দানবটি খেয়ে ফেলেছে। তাই সমাজের উঁচু স্তর থেকে নিচু স্তর পর্যন্ত দুর্নীতিকে ‘না’ বলতে হবে। দুর্নীতি নামক বস্তু সম্পর্কে আমাদের সকলের সমস্বরে না বলতে হবে। বিজয় দিবসে আমাদের শিক্ষা এখন হতে হবে দুর্নীতিকে ‘না’ বলা। আমরা কি সকলে দুর্নীতিকে ‘না’ বলার সৎসাহস দেখাতে পারব! আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে। এখন দুর্নীতি দমন কমিশনের ১৩ বছর অতিক্রম করলো। দুর্নীতি দমন কমিশন কি বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবে, তারা সঠিকভাবে দুর্নীতি দমন করতে কাজ করতে পারছে বা করছে! রাষ্ট্রকে দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন করে দিতে হবে। রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণে যত দিন দুর্নীতি দমন কমিশন থাকবে তত দিন দুর্নীতি দমন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না। বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন বা বলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ কমিশন বলতে পারেন। সরকার ইচ্ছা করলে দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য কাজ করতে পারেন। কন্ট্রোল করতে পারেন। আবার ইচ্ছা করলে স্বাধীনভাবেও কাজ করাতে পারেন। এই প্রতিষ্ঠানকে সকল রাজনৈতিক দলের ঊর্ধ্বে রেখে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ দিতে হবে। তা না হলে সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করা যাবে না। দুর্নীতিকে সহনশীল পর্যায়েও রাখা যাবে না। পৃথিবীর সকল দেশে দুর্নীতি রয়েছে। কোথাও কোথাও অসহনশীল পর্যায়ে, কোথাও বা সহনশীল পর্যায়ে দুর্নীতি রয়েছে। কিন্তু আমাদের মত একটি নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে দুর্নীতিকে অত্যন্ত সহনশীল পর্যায়ে নিয়ে আসা প্রয়োজন। বিজয় দিবসে জাতি সকলের নিকট সেই আশা পোষণ করে।
বিজয় দিবস নৈতিকতা ও মূল্যবোধ : আমাদের সংগ্রাম হচ্ছে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের বিকাশের জন্য। কিন্তু আজ আমাদের নৈতিকতা ও মূল্যবোধ অনেক অনেক দূরে অবস্থান করছে। সমাজের সকল স্তর থেকে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের দারুণ অভাব। ১৯৭১ সালে আমরা সকল অন্যায়, অবিচার, মূল্যহীন জীবনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করি। তা পরবর্তীতে মুক্তি সংগ্রামে রূপ নেয়। কিন্তু স্বাধীনতার দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেও আমরা আমাদের লক্ষ্য অর্জন করতে পারি নাই। শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের অনেক পরিবর্তন এসেছে। অকে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় দেশে স্থাপিত হয়েছে। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা প্রতিদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাসের হারও বেশ সম্প্রসারিত হয়েছে। পাসের হারও বেশ ভাল। কিন্তু নৈতিক শিক্ষা, মূল্যবোধের শিক্ষা, মনুষ্যত্বের শিক্ষা আমরা দিতে এখনও সক্ষম হয় নাই। বিজয় দিবসে আমাদের মনে এই সকল চিন্তা নানাভাবে ঘোরপাক খাচ্ছে। এই দিনে আমাদেরকে এই সকল বিষয়ে আরও শক্তিশালী হওয়ার দৃঢ়তা শিক্ষা দেয়।
আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরে কারিকুলামে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় এমন পরিবর্তন আনতে হবে যাতে করে শিশুকাল থেকে ছাত্রছাত্রীগণ নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষ হয়ে নিজকে গড়ে তুলতে পারে। শিক্ষা ছাড়া তথা সুশিক্ষা ছাড়া কোনক্রমেই  নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা হবে না। মানুষ সত্যিকার মানুষ হতে পারবে না। সার্টিফিকেট সম্পন্ন কিছু যুবক-যুবতী তৈরি করলে দেশ কখনও মৌলিক শিক্ষা লাভ করতে পারবে না। শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে নৈতিকতা ও মূল্যবোধের চর্চা নিজেদের মধ্যে করতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষকম-লী ছাড়া নৈতিকতা ও মূল্যবোধসম্পন্ন ছাত্রছাত্রী তৈরি হবে না। তাই প্রথমে শিক্ষককে সুশিক্ষক হতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোধ সম্পন্ন শিক্ষকম-লী তৈরির জন্য কর্ম পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। বিজয় দিবস আমাদেরকে তা শিক্ষা দেয় তা দাবি করে।
জাতীয় ঐক্য ও রাজনীতি : বিজয় দিবসে নানা ভাবান আমাদের মনের মধ্যে এসে পড়ে। ১৯৭১ সালে জাতি ঐক্যবদ্ধভাবে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কোন বিভেদ, অনৈক্য আমাদের মধ্যে ছিল না। রাজনৈতিকভাবে আমরা সকলে ঐক্যবদ্ধভাবে দেশ স্বাধীনের জন্য যুদ্ধ করেছি। সেই ঐক্যের রাজনীতি আমাদের এখন বড় প্রয়োজন। জাতি আজ প্রায় দুই শিবিরে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। জাতীয় বড় বড় ইস্যুতে পর্যন্ত আমরা সকল রাজনৈতিক দল এক সুরে কথা বলতে পারছি না। বিগত জাতীয় নির্বাচন সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ হয় নাই বলে দেশে বিদেশে তা গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করতে পারে নাই। তাই আগামী নির্বাচন সরকার চাচ্ছেন সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণমূলক স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ ও সকলের গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করতে। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন আমাদের দেশের চেহারা পাল্টে দেবে। দেশে বিদেশে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক বেড়ে যাবে। আমাদের দেশে দেশী বিদেশী বিনিয়োগ ও এখন বৃদ্ধি পাবে। আশা করা যায় আগামী নির্বাচনকে একটি মডেল হিসাবে সরকার ও বিরোধী রাজনৈতিক দলসমূহ গ্রহণ করে জাতিকে সকল কালিমা থেকে মুক্ত করবে। তাই সরকারকে সকলের পূর্বে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করার জন্য এগিয়ে আসতে হবে। সকল রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে নিরপেক্ষ, স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। মেরুদ-হীন নির্বাচন কমিশন দিয়ে নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কখনও আশা করা যায় না। আজকের বিজয় দিবসে আমাদের প্রাণের দাবি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ, শক্তিশালী জবাবদিহিমূলক সরকার উপহার দেয়া।
আইনের শাসন ও সুবিচার নিশ্চিত করা : আমাদের স্বাধীন বিচার বিভাগ রয়েছে। সরকার বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ তৈরি করে দিয়েছেন। এখন বিচার বিভাগের প্রয়োজন তাদের যোগ্যতা ও স্বচ্ছতার নজির স্থাপন করা। বিচারহীনতাকে বের হয়ে আসা। আইনের শাসন সকলের নিকট সমান ও গ্রহণযোগ্য তা প্রমাণ করার জন্য বিচার বিভাগকে  এগিয়ে আসতে হবে। সুবিচার নিশ্চিত করা প্রয়োজন। আজও সাধারণ মানুষ অভিযোগ করে ন্যায় বিচার হতে তারা বঞ্চিত। এই অভিযোগ যাতে কেউ করতে না পারে সেই রকম গ্রহণযোগ্য পর্যায়ে বিচার বিভাগ হতে হবে।
আইনের শাসনকে সহজ ও সহজ লক্ষ্য করতে হবে। বিচার কাজের খরচ অনেক বেশি। সাধারণ একজন নাগরিক ন্যায়বিচার আসায় অধিক খরচের জন্য আদালতে  যেতে পারে না। বিশেষ করে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টে নানা খরচ অধিক হওয়ার কারণে সাধারণ আয়ের মানুষ মামলা পরিচালনা করতে পারে না। খরচ কমাতে হবে। খরচ কমানোর জন্য সরকারও বিচার বিভাগকে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসতে হবে।
দেশে গুম, খুন, হত্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। তার মূল কারণ ন্যায় বিচার, দ্রুত বিচার থেকে মানুষ বঞ্চিত। দ্রুত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারলে সমাজ থেকে গুম, খুন, অবিচার, অত্যাচার অনেক ক্ষেত্রে বেশ হ্রাস পেত। বিজয় দিবসে আমাদের ভাবনা ও ইচ্ছা ন্যায়বিচার, নিরপেক্ষ ও দ্রুত বিচার কার্যকর দেখতে চাই। তবেই আমাদের বিজয় হৃদয় মনে উৎফুল্লতা এনে দেবে।

লেখক: সাবেক সহ-সভাপতি, এফবিসিসিআই, বিটিএমএ, বিজেএমইএ ও প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনির্ভাসিটি 

জিয়ার অবদান

ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক

বর্তমান বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিে তিনজন মরহুম রাজনৈতিক নেতা খুবই সম্মানের অধিকারী। তাদের ছাড়া আরো মরহুম সম্মানীয় নেতা রয়েছেন, যাদের অবদান অস্বীকার করা হবে খুবই অন্যায়। তবুও ইতিহাসের নিরিখে তিনজনের নামই সামনে চলে। তারা হলেন- বঙ্গবন্ধু, শহীদ জিয়া ও মওলানা ভাসানী। তাদের অনুসারীদের ভেতর কিছু দ্ব›দ্ব থাকলেও এই মহান নেতাদের অবদান জাতীয় ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ক্ষমতার অঙ্গনে আওয়ামী লীগ ও বিরোধী ক্ষেত্রে ন্যাপ (ভাসানী) ও পরবর্তীতে একই ক্ষেত্রে জাসদ থাকলেও সবাইকে টেক্কা দিয়ে জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সামনের কাতারে চলে আসে। জাসদের বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ধর্মভীরু বাঙালি সমাজে মূল্য পায়নি। আর ন্যাপ (ভাসানী)ও সুবিধা না করতে পাওয়ায় জিয়ার ডাকে বিএনপিতে ঢুকে পড়ে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী বিএনপিতে প্রাথমিকভাবে শতকরা ষাট ভাগ ন্যাপ (ভাসানী), ত্রিশ ভাগ মুসলিম লীগ ও বাকি দশ ভাগ অন্যান্য দল থেকে আসা সমর্থনকারী ছিল। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বাংলাদেশে ন্যাপ ক্ষমতার সাধ না পেলেও (তবে অতীতে তার নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগ তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে ক্ষমতায় ছিল), ন্যাপ (ভাসানী)-এর নেতা-কর্মীরা জিয়ার মাধ্যমে ক্ষমতার অংশীদার হতে সমর্থ হয়। অথচ জাসদ খুবই সুগঠিত দল হওয়া সত্তে¡ও সফলতার মুখ দেখেনি। তারা বারবার ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
কি সেই আকর্ষণ যা জনগণ লুফে নেয় জিয়ার নেতৃত্বে? যে কারণে আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে সফল হয় ঐ একই প্রকার কারণে জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপির হয় জয়জয়কার। আওয়ামী মুসলিম লীগ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে রব্বানী দর্শন, কুরআন-সুন্নাহবিরোধী আইন না করার ওয়াদা করে সাধারণ ভোটারদের আকৃষ্ট করতে সমর্থ হয়। আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক মুসলমানী টুপি পরে দলের আদর্শ প্রচারে সারা দেশ ঘোরেন। তিনি একজন ঘাঁটি বাঙালি মুসলমান ছিলেন। তার লেখা বই বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম, ইসলাম দ্য অনলি সলুশন (১৫০ মোগলটুলী, ঢাকা থেকে প্রকাশিত) ও অন্যান্য লেখায় দলের আদর্শ স্পষ্ট হয়। বৈপ্লবিক দৃষ্টিতে ইসলাম গ্রন্থের সূত্র হিসেবে শামসুল হক সহকারী ইকবাল, আল্লামা আজাদ সোবহানী ও তমদ্দুন মজলিসের নেতা আবুল হাশিমের লেখার উল্লেখ করেছেন। এই বইয়ের একটি নিবন্ধের নাম রবুবিয়াৎ-এর স্তর তখনকার আওয়ামী মুসলিম লীগ নেতারা যে কতটা তমদ্দুন মজলিসের দ্বারা প্রভাবান্বিত, তা এটা প্রমাণ করে এই বইয়ে হক লেখায় এখন নিঃসন্দেহে একথা বলা যেতে পারে, যারা অন্ধ মার্কসবাদী যারা মনে করেন মার্কসবাদ অভ্রান্ত বৈজ্ঞানিক সত্যের ওপর প্রতিষ্ঠিত তারা ভ্রান্ত। ইসলাম সম্পর্কে সম্যক ও সত্যজ্ঞান না থাকার দরুনই তারা এ দাবি করেন। মানবতা ও সৃষ্টি পুরোপুরি মুসলিম হিসেবে গড়ে উঠবেইÑ দুনিয়ায় চিরন্তন শান্তি বা ইসলাম কায়েম হবেই। (পৃষ্ঠা ১০-১১)।
শামসুল হক আরো লিখেন ইসলাম ছাড়া অন্য কোনো মতবাদ সমাজ বিধান মানুষকে চিরন্তন সুখ, শান্তি, উন্নতি প্রগতি ক্রমবিকাশ ও পূর্ণতা প্রাপ্তির সন্ধান দিতে পারে না। চরম পরিতাপের বিষয় এই যে, মুসলমানরাও জীবন ও জীবনাদর্শ সম্পর্কে আজ কমবেশি এ দু’টি বিপরীতমুখী পাশ্চাত্য দৃষ্টিভঙ্গির দ্বারা (সাম্যবাদী ও পুঁজিবাদী) এ ভাবান্বিত। ফলে তারাও দিশেহারা বর্তমান জগতকে সঠিক পথ নির্দেশ করতে পারছেন না। (পৃষ্ঠা ১২৪-১২৫)। এই ছিল আওয়ামী মুসলিম লীগের দর্শন, যা ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টকে বিশাল বিজয় এনে দেয়। জিয়া বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে সেই ইসলামী আদর্শেরই আশা শোনান জাতিকে। জিয়া আসলে মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুরই উত্তরসূরি যদিও কেউ কেউ হয়তো এ মূল্যায়নে দ্বিমত পোষণ করবেন। আমাদের তিন মরহুম নেতাই ছিলেন খাঁটি বাঙালি মুসলিম। বাংলাদেশের সংস্কৃতির মূল ধারাকে তারা ধারণ করেন। শেখ মুজিব তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে লেখেন ‘আমাদের বাঙালির মধ্যে দুইটা দিক আছে একটা দল আমরণ মুসলমান, আর একটা বাঙালি’ (পৃষ্ঠা ৪৭)।
আজ যদি এই তিন মহান নেতার ‘টিম’টা থাকত, দেশের ও জাতির মহা কল্যাণ হতো। তারা বেঁচে থাকলে বিশেষ করে পররাষ্ট্রনীতি সঠিক অবস্থানে থাকত। তাদেরই ‘গাট্স্’ ছিল জাতির সম্মান রক্ষার মনোবলে। জিয়া কোনো সময় বঙ্গবন্ধুবিরোধী ছিলেন না। তিনি বঙ্গবন্ধুর নামেই তার ঘোষণা সংশোধন করে রেডিওতে বক্তব্য রাখেন বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে তার পররাষ্ট্রনীতি আরো জোরালো হতো, যা করার সুযোগ জিয়ার ভাগ্যে আসে। জিয়া যা করেছিলেন পররাষ্ট্রনীতিতে বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে ক্রমান্বয়ে তাই করতেন, কারণ দু’জনই ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। জিয়া আসলে বঙ্গবন্ধু পররাষ্ট্রনীতিকে ‘ফাইন টিউনিং’Ñ আরো শাণিত করেন। মুসলিম বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক ও উন্নয়ন করে যার সূত্রপাত বঙ্গবন্ধু করেন। চীনের সঙ্গে যোগাযোগও বঙ্গবন্ধু শুরু করেন। জিয়া তা আরো স্পষ্ট রূপ দেন।
জিয়া সম্পর্কে অযথা চরিত্র হনন করা হয় এই বলে যে, তিনি পাকিস্তানি এজেন্ট ইত্যাদি। এগুলো রাজনৈতিক ঈর্ষার প্রকাশ। জিয়া তো ছিলেন চট্টগ্রামে ৮ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সহ-অধিনায়ক। ২৫ মার্চ ১৯৭১ মধ্য রাতে জিয়া তার অনুগত বাঙালি সৈনিকসহ বিদ্রোহ করলেন এবং নিজের ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল আবদুর রশিদ জানজুয়াকে বন্দী করেন। যিনি পরে নিহত হন। মুক্তিযোদ্ধা (অবসরপ্রাপ্ত) মেজর জেনারেল মুহাম্মদ ইব্রাহিম বীর প্রতীক আমাকে এই তথ্য সঠিক বলে জানিয়েছেন। এটা এমন এক দুঃসাহসিক ঘটনা যা পরিস্থিতিকে যুদ্ধের দিকে টেনে নেয়। জিয়ার পরিবার তখন ঢাকায়। জিয়া এমন ঝুঁকি নিলে বিদ্রোহ ব্যর্থ হতো। তাহলে তাকে পাক বাহিনীর ফায়ারিং স্কোয়াডের সম্মুখীন হতে হতো। এরপরও রয়েছে তার কালুরঘাটের রেডিও ঘোষণা। তার এসব সামরিক তৎপরতায় তখন বঙ্গবন্ধুর পর তাকেই পাকিস্তানের প্রধান শত্রæ মনে করা হতো। অথচ ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, তাকে পাকিস্তানের এজেন্ট বলা হচ্ছে। এটা দৃঢ়ভাবে বলা যেতে পারে যে, জিয়াসহ বঙ্গবন্ধু ও মওলানা ভাসানী কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের এজেন্ট ছিলেন না। তারা ছিলেন প্রকৃত দেশপ্রেমিক। মৃতদের চরিত্র হনন হাদিসবিরোধীও। জিয়া একজন খাঁটি বাঙালি মুসলমান ছিলেন, যিনি অন্য ধর্মাবলম্বীদের ওপরও ছিলেন উদার, যা তার বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নীতিতে সুস্পষ্ট।

লেখক : গবেষক ও ইতিহাসবিদ।

জিয়া কেন স্মরণীয়?

মহিউদ্দিন খান মোহন


প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমান এ দেশের মানুষের কাছে কেন এত প্রিয় এটা নিয়ে অনেকেই ভেবে থাকেন। একজন সেনানায়ক ধূমকেতুর মতো হঠাৎ দেশের রাজনীতিতে আবির্ভূত হলেন, তারপর জনপ্রিয়তার শীর্ষে উঠে গেলেন। কী এমন জাদু ছিল তার রাজনীতির বাঁশিতে, যার সুর এ দেশের মানুষকে বিমোহিত করেছিল। কী এমন রাজনীতি তিনি দিয়ে গেছেন এ দেশের মানুষকে, যা তাদের এখনো আন্দোলিত করে?

ওপরের প্রশ্নগুলো প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ছত্রিশতম শাহাদতবার্ষিকীর দিনে কতটা প্রাসঙ্গিক বা অপ্রাসঙ্গিক সে বিতর্কে যাবার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। তবে এটা ঠিক যে, শাহাদতের তিন যুগ পর প্রশ্নগুলোর উত্তর খোঁজা এবং পর্যালোচনা অত্যাবশ্যক হয়ে পড়েছে। কেননা, তার অবর্তমানে, যখন তার পৃথিবীর মানুষকে কিছু বলার বা কারো কথার জবাব দেয়ার ক্ষমতা বা সুযোগ কোনোটাই নেই, সে সময়ে কিছু সংখ্যক লোক তাকে নিয়ে কুৎসা রটনা করছে, অপপ্রচার চালাচ্ছে। বলা বাহুল্য, যারা প্রেসিডেন্ট জিয়াকে নিয়ে নানা রকম কাল্পনিক, উদ্ভট, আর বিকৃত মিথ্যাচার করে চলেছে, তারা তার বিরুদ্ধবাদী এবং তার জনপ্রিয়তায় ঈর্ষাকাতর। এরা মুখ খোলার মওকা পেলেই জিয়াউর রহমানের নামে গর গর করে উগড়ে দেয় কুৎসার গরল। এদের পরিচয় নতুন করে দেয়ার প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না। এরা তারাই, যারা ঊনিশ শ’ একাত্তরে পাক হানাদার বাহিনীর আক্রমণের পর নিজেদের জীবন বাঁচাতে যে যেদিকে পেরেছিল সরে পড়েছিল। এরা তো তারাই, যারা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে ‘সুশাসন’ কায়েমের পরিবর্তে দুঃশাসনের ‘কালো ঘোড়া’ দাবড়ে জনজীবনকে দুঃসহ করে তুলেছিল। এরা তো তারাই, যারা স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের সুখ স্বপ্নকে সীমাহীন লুটতরাজ, নৈরাজ্য আর ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের দ্বার দুঃস্বপ্নে পরিণত করেছিল। ফলে ওই গোষ্ঠীটি সফল রাষ্ট্রনায়ক জিয়াউর রহমানের প্রতি ঈর্ষান্বিত। ক্রিসেন্ট লেকের উত্তর পাশের সবুজ আঙ্গিনায় মানুষ যখন দল বেঁধে তাদের প্রিয় নেতাকে শ্র্দ্ধা জানাতে যায়, তখন তাদের গাত্রদাহ সৃষ্টি হয়। অসহ্য মনোযন্ত্রণায় অস্থির হয়ে তারা হামলে পড়ে জিয়া নামটির ওপর।
১৯৭১। আমাদের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ, ভয়ঙ্কর ও গৌরবের বছর। কারণ, ওই বছরে বাংলাদেশের রাজনীতি স্বাধীনতার এক দফায় এসে দাঁড়িয়েছিল। জাতির সিদ্ধান্ত নেয়ার সে বছরটি তাই ছিল অত্যন্ত গুরুত্ববহ। আমরা যদি সেদিন সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করতাম, কিংবা দ্বিধান্বিত হতাম, তাহলে জাতির ভাগ্য হয়তো দুর্ভাগ্যের কালিতে লেখা হতো। একই সঙ্গে ১৯৭১ ছিল এক ভয়ঙ্কর বছর। কারণ, সে বছর এ দেশে সংঘটিত হয়েছিল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বর্বরোচিত গণহত্যা। আর গৌরবের বছর এজন্য যে, ওই বছরই আমরা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে আমাদের স্বাধীনতাকে অর্জন করেছি। আর সে ঐতিহাসিক বছরেই বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল এক ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের। তিনি জিয়াউর রহমান। মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী একজন যুবক গোটা জাতিকে উজ্জীবিত করে ফেললেন একটি মাত্র ঘোষণার দ্বারা। ‘আমরা বিদ্রোহ করলাম’ এবং ‘আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করছি’Ñ কথাগুলো যখন ইথারে ভেসে এ দেশের ভীতসন্ত্রস্ত মানুষের কানে পৌঁছল, তারা যুগপৎ বিস্মিত ও উজ্জীবিত হলো। তারা বিস্মিত হয়েছিল এ জন্য যে, যার নাম তারা কখনো শোনেননি, কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাও যিনি নন, তিনি কোন সাহসে একটি দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দিতে পারলেন! হ্যাঁ, জিয়াউর রহমান সেটা পেরেছিলেন। কারণ, তাঁর হৃদয়ে দেশপ্রেম ছিল। সে প্রেমে কোনো খাদ ছিল না। কোনো লোভ-লালসা বা কোনো প্রাপ্তির আকাক্সক্ষাও ছিল না। বোধহয় ভুল বলা হলো। প্রাপ্তির আকাক্সক্ষা তাঁর ছিল। সেটা হলোÑ একটি স্বাধীন দেশের গর্বিত নাগরিক হওয়ার প্রবল আকাক্সক্ষা তার মধ্যে ছিল। আর সে জন্যই তিনি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়ে সঠিক কাজটি করতে পেরেছিলেন। ক্রিকেট খেলায় ‘টাইমিং’টা ব্যাটসম্যানদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যাটসম্যান বোলারের বলে সঠিক সময়ে হিট করতে পারে, বাউন্ডারি সে-ই হাঁকায়। যারা তা পারে না, তারা হয় বোল্ড আউট। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ রাতে টাইমিংটা জিয়াউর রহমান ভালোভাবেই কাজে লাগাতে পেরেছিলেন। যার ফলে মুহূর্তের মধ্যে তিনি অজ্ঞাত-অপরিচিত থেকে ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হলেন।
আজ যখন ১৯৭১-এ জিয়াউর রহমানের ভূমিকা নিয়ে কেউ কেউ নানা ধরনের কল্পকাহিনী বলে, কটাক্ষ করে, তখন সঙ্গত কারণেই এ দেশের মানুষের মনে প্রশ্ন জাগেÑ এরা কারা। কোথায় ছিল এরা ১৯৭১-এ? সেদিন তো তাদের কাউকে খুঁজে পাওয়া যায়নি! প্রধান নেতা পাকিস্তানি সামরিক জান্তার কারাগারে চলে যাবার পর দিশেহারা কিংকর্তব্যবিমূঢ় জাতিকে একটু সাহসের বাণী, এটু আলোর দিশা দেয়ার জন্য তো কাউকে পাওয়া যায়নি। এটা ঠিক যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা দেয়ার জন্য জিয়াউর রহমানকে কেউ সেদিন দায়িত্ব দেয়নি। তিনি স্বেচ্ছায় সে দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন। কেন তিনি সেদিন নিজের ও পরিবারের সদস্যদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এ কাজটি করেছিলেন? এর একমাত্র কারণ দেশপ্রেম। যাদের হৃদয়ে দেশপ্রেম সর্বদা জাগরিত থাকে, দেশ ও জাতির সঙ্কটময় মুহূর্তে তাদেরকে কারো হুকুম দিতে হয় না, নির্দেশনা দিতে হয় না। হৃদয়ে লালিত দেশপ্রেমই তাদেরকে বলে দেয় কী করতে হবে, কোন পথে যেতে হবে। ১৯৭১-এ জিয়াউর রহমানের বেলায় সেটাই ঘটেছিল। তাঁর দেশপ্রেম আলোকবর্তিকা হয়ে তাঁকে দেখিয়েছে এগিয়ে যাবার পথ।
কিছু বিরুদ্ধবাদী আছেন, যারা বাংলাদেশের তাবৎ খারাপ কাজের জন্য জিয়াউর রহমানকে দায়ী করে থাকেন। তাদের মধ্যে এমন লোকও আছেন যারা জিয়াউর রহমানের বদান্যতায় রাজনীতি করার সুযোগ পেয়েছেন, বড় বড় চেয়ার দখল করার মওকা পেয়েছেন। কিন্তু তারা এটা খেয়াল করেন না যে, স্বাধীনতার পর জিয়াউর রহমান নিজ পেশায় চলে গিয়েছিলেন। কারণ, তিনি ছিলেন একজন পেশাদার সৈনিক। পেশাদার সৈনিক হিসেবেই তিনি দেশ ও জাতির সেবায় নিবেদিত হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ঘটনাক্রমে তিনি জড়িয়ে গেলেন রাষ্ট্র পরিচালনার কার্যক্রমের সাথে। ভাগ্যই তাঁকে টেনে নিয়ে এলো রাজনীতির পাদপ্রদীপে। তিনি পরিণত হলেন বাংলাদেশের রাজনীতির বাঁক পরিবর্তনের মহানায়কে। যারা জিয়াউর রহমানের সমালোচনা করেন, তারা এটা ভেবে দেখেন না যে, এ সমালোচনার অধিকারটুকুও তাঁরই অবদান। তিনি বাকশালের নিগড় থেকে এদেশের মানুষকে মুক্তি দিয়েছিলেন, ফিরিয়ে দিয়েছিলেন তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। জিয়াউর রহমান ইচ্ছে করলে বাকশালী সংবিধান বহাল রেখে খুব সহজেই রাষ্ট্রক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি সেটা করেননি। কেননা, তিনি ছিলেন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। তিনি বিশ্বাস করতেন জনগণই রাষ্ট্রের মালিক এবং তারাই রাষ্ট্রীয় সব ক্ষমতার উৎস। আর সে জন্যই তিনি জনগণের হাতে রাষ্ট্রের নেতৃত্ব নির্ধারণের ক্ষমতা দিয়ে দিলেন। একদলীয় স্বৈরশাসনের অবসান ঘটিয়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুনর্বহাল করলেন। আজ ছোট-বড় যেসব রাজনৈতিক দলের নেতারা জিয়াকে নিয়ে উল্টাপাল্টা কথাবার্তা বলেন, তারা কি একবারও ভেবে দেখেন, জিয়াউর রহমান বহুদলীয় ব্যবস্থা ফিরিয়ে না আনলে তারা আজ কোথায় অবস্থান করতেন?
জিয়াউর রহমানের আরেকটি মহৎ অবদান এ দেশের সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়া। বাকশাল সরকার চারটি দৈনিক পত্রিকা রেখে দেশের সব পত্রপত্রিকা বন্ধ করে দিয়েছিল। জিয়াউর রহমান সে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়ে সংবাপত্রের স্বাধীনতাকে অবারিত করে দেন। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বহু পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ওগুলোর মধ্যে কিছু পত্রিকা জিয়া সরকারের, এমনকি প্রেসিডেন্ট জিয়াকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করে সংবাদ-নিবন্ধ প্রকাশ করলেও তিনি কখনো ক্ষুব্ধতা প্রকাশ করেননি। আসলে গণতন্ত্র ও বাকস্বাধীনতায় বিশ্বাসী জিয়াউর রহমান সমালোচনাকে সহজভাবেই গ্রহণ করতে জানতেন। কারণ আক্ষরিক অর্থেই তিনি একজন গণতন্ত্রী ছিলেন ।
মৃত্যুর ছত্রিশ বছর পরও জিয়াউর রহমান এ দেশের মানুষের কাছে প্রিয় একটি নাম। সময়ের ব্যবধান তাঁর প্রতি এ দেশের মানুষের ভালোবাসার তারতম্য সৃষ্টি করতে পারেনি। একজন সৎ, দেশপ্রেমিক, মানবতাবাদী এবং জনদরদী রাষ্ট্রনায়কের কথা চিন্তা করলেই জিয়াউর রহমানের নামটি চলে আসে। বিদ্বেষীরা যতই ঈর্ষান্বিত হোক, জিয়া আপন কর্মের গুণেই এদেশের মানুষের হৃদয় সিংহাসনে স্থায়ী আসন লাভ করেছেন। কারণ, তিনি তাদের ভাগ্য পরিবর্তনের পথ দেখাতে পেরেছিলেন। তিনি রাজনীতিকে কেবলমাত্র রাষ্ট্রক্ষমতায় যাবার বাহন হিসেবে দেখেননি। দেখেছেন দেশ ও জনগণের ভাগ্যোন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে। তিনি প্রাসাদ থেকে রাজনীতিকে নিয়ে গিয়েছিলেন তাদের কাছে, যারা দেশের প্রকৃত মালিক এবং যাদের জন্যই রাজনীতি। তিনি জনগণকে এই বলে সচেতন করে তুলেছিলেন যে, রাজনীতি তাদের জন্য এবং তাদেরকে অবহেলা-অবজ্ঞা করে এ দেশে রাজনীতি করা যাবে না।
এ দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে জিয়াউর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ১৯ দফা কর্মসূচি দিয়েছিলেন। এটা ছিল একটি কালজয়ী ঘোষণাপত্র। যেখানে বাংলাদেশকে সমৃদ্ধির শিখরে নিয়ে যাবার দিকনির্দেশনা ছিল। গত ছত্রিশ বছরে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় পালাবদল ঘটেছে অনেকবার। তাঁর প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল বিএনপিও ক্ষমতায় এসেছে তিনবার। লক্ষণীয় বিষয় হলো, ওই সরকারগুলো দেশের উন্নয়নে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করলেও তারা জিয়াউর রহমানের ১৯ দফাকে অতিক্রম করে যেতে পারেনি। চল্লিশ বছর পরও বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে প্রেসিডেন্ট জিয়ার ১৯ দফা আজও প্রাসঙ্গিক, সেটাকে এড়িয়ে যাবার উপায় নেই। কারণ তাঁর ১৯ দফা একটি বিশেষ সময়ের জন্য প্রণীত ছিল না, ওটা ছিল যুগোত্তীর্ণ একটি ভিশন। জিয়াউর রহমানের ১৯ দফা পর্যালোচনা করলে এ সত্যটি প্রতিভাত হয়ে উঠবে। তাঁর সে উন্নয়ন পরিকল্পনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, চিকিৎসা, গ্রামোন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়নসহ সবকিছুই অন্তর্ভুক্ত ছিল। আজ যেসব রূপকল্প-ভিশন আমরা দেখছি, সেগুলো প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের ১৯ দফারই নবতর সংস্করণ। পার্থক্য শুধু সময় এবং পরিবেশের। জিয়াউর রহমান তিন যুগ আগে যে ভিশন ঘোষণা করে গেছেন, আজকের রাজনৈতিক দলগুলো তার পরিবর্ধন-পরিমার্জন ও যুগোপযোগী করে পরিবেশন করছে। এখানেই জিয়াউর রহমানের সাফল্য। একটি কথা বলা বোধকরি অত্যুক্তি হবে না যে, জিয়াউর রহমানের ১৯ দফাকে বাদ দিয়ে বা এড়িয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন করা কারো পক্ষে সম্ভব নয়। বস্তুত: ভিশনারি লিডার যারা, তাঁদের কাজগুলো এমনই হয়। তিনি চলে যান, কিন্তু তাঁর কাজ, তাঁর কথা তাঁকে অমর করে রাখে। তাঁরা তাঁদের দেশপ্রেম, জাতীয়তাবোধ এবং জনগণের প্রতি কমিটমেন্টের কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকেন।
জিয়াউর রহমান এ দেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকার আরেকটি কারণ আমাদের জাতিসত্তার উদঘাটন। ‘আমরা বাংলাদেশী’Ñ এ পরিচয়ে বিশ্বসমাজে মাথা উঁচু করে চলার কথা তিনিই বলে গেছেন। ভাষাগত সাযুজ্যের কারণে প্রতিবেশী একটি দেশের একটি অঙ্গরাজ্যের নাগরিকদের সাথে আমাদের জাতীয়তাকে গুলিয়ে ফেলা হয়েছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সে বিভ্রান্তির অবসান ঘটান তাঁর ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’ তত্ত¡ উপস্থাপনের মাধ্যমে। বাংলাদেশের নাগরিকদের জাতিগত এ পরিচিতি উদঘাটনের জন্য তিনি এদেশের মানুষের কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন এবং থাকবেন।
প্রেসিডেন্ট শহীদ জিয়াউর রহমানকে পুরোপুরি বিশ্লেষণ করা ছোট পরিসরে সম্ভব নয়। স্বল্পদৈর্ঘ্যের রাজনৈতিক জীবনে তিনি এত বড় বড় কাজ করে গেছেন যে, সেসব তুলে ধরতে হলে বিশাল ক্যানভাস প্রয়োজন। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকের হৃদয়ই হলো সে ক্যানভাস, যেখানে কোনো শিল্পীর তুলির ছোঁয়া ছাড়াই অঙ্কিত হয়ে আছে কর্মবীর এ রাষ্ট্রনায়ক ও তাঁর কীর্তির ছবি। হাজারো চেষ্টা করলেও সে ছবি মুছে ফেলা কারো পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না।

লেখক : সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

একটি জাতির জন্ম : জিয়াউর রহমান

শহীদ জিয়াউর রহমান


পাকিস্তান সৃষ্টির পরপরই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতে মি: জিন্নাহ যেদিন ঘোষণা করলেন উর্দু এবং একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা। সেদিন নিজের অজান্তে পাকিস্তানের স্রষ্টা নিজেই অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের ধ্বংসের বীজটাও বপন করে গিয়েছিলেন- এই ঢাকার ময়দানেই। এই ঐতিহাসিক নগরী ঢাকাতেই মি: জিন্নাহ অত্যন্ত নগ্নভাবে পদদলিত করেছিলেন আমাদের জনগণের জন্মগত অধিকার। আর এই ঐতিহাসিক ঢাকা নগরীতেই চূড়ান্তভাবে খন্ড-বিখন্ড হয়ে গেল তার সাধের পাকিস্তান। ঢাকা নগরী প্রতিশোধ নিলো জিন্নাহ ও তার অনুসারীদের নষ্টামীর। বীর নগরীর পবিত্র মাটিতে দাঁড়িয়ে প্রথমেই আমি এই সংগ্রামী ঢাকা ও ঢাকাবাসীর উদ্দেশে শির নত করেছি অকুণ্ঠ শ্রদ্ধায়।
পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের সপ্তাহ খানেক পর একজন সাংবাদিক আমাকে বলেছিলেন, সেই দুঃস্বপ্নে ভরা দিনগুলো সম্পর্কে কিছু স্মৃতিকথা লিখতে।
ভারত ভেঙে দু’ভাগ হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল অস্বাভাবিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের। আর তার অব্যবহিত পরই আমরা চলে গিয়েছিলাম করাচি। সেখানে ১৯৫২ সালে আমি পাস করি ম্যাট্রিক। যোগদান করি পাকিস্তান সামরিক অ্যাকাডেমিতে। অফিসার ক্যাডেটরূপে। সেই থেকে অধিকাংশ সময়ই বিভিন্ন স্থানে আমি কাজ করেছি পাকিস্তানি বাহিনীতে।
স্কুলজীবন থেকেই পাকিস্তানিদের দৃষ্টিভঙ্গির অসচ্ছলতা আমার মনকে পীড়া দিত। আমি শুনতাম মাঝে মাঝেই, শুনতাম তাদের আলোচনার প্রধান বিষয় হতো বাংলাদেশকে শোষণ করার বিষয়। পাকিস্তানি তরুণ সমাজকেই শেখানো হতো বাঙালিদের ঘৃণা করতে। বাঙালিদের বিরুদ্ধে একটি ঘৃণার বীজ উপ্ত করে দেয়া হতো স্কুলছাত্রদের শিশু মনেই।
১৯৫২ সালে মশাল জ্বলল আন্দোলনের। ভাষা আন্দোলনের। আমি তখন করাচিতে। দশম শ্রেণীর ছাত্র তখন। পাকিস্তানি সংবাদপত্র, প্রচার মাধ্যম, পাকিস্তানি বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মচারী, সেনাবাহিনী, আর জনগণ সবাই সমানভাবে তখন নিন্দা করেছিল বাংলা ভাষার নিন্দা করেছিল বাঙালিদের।...... তাদের রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে তারা এটাকে মনে করেছিল এক চক্রান্ত বলে। এক সুরে তাই তারা চেয়েছিল একে ধ্বংস করে দিতে। আহ্বান জানিয়েছিল এর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের। কেউবা বলত- ‘বাঙালি জাতির মাথা গুঁড়িয়ে দাও।’ কেউ বলত- ‘ভেঙে দাও এর শিরদাঁড়া’।
১৯৫৪ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হলো নির্বাচন। যুক্তফ্রন্টের বিজয় রথের চাকার নিচে পিষ্ট হলো মুসলিম লীগ। বাঙালিদের আশা- আকাক্সক্ষার মূর্ত প্রতীক যুক্তফ্রন্টের বিজয় কেতন উড়ল বাংলায়। আমি তখন দ্বিতীয় পর্যায়ের ক্যাডেট। আমাদের মনেও জাগল তখন পুলকের শিহরণ। যুক্তফ্রন্টের বিরাট সাফল্যে আনন্দে উদ্বেলিত হলাম আমরা সবাই পর্বতে ঘেরা অ্যাবোটাবাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। আমরা বাঙালি ক্যাডেটরা আনন্দে হলাম আত্মহারা। খোলাখুলিভাবে প্রকাশ করলাম সেই বাঁধভাঙা আনন্দের তরঙ্গমালা।
এই সময়েই একদিন কতকগুলো পাকিস্তানি ক্যাডেট আমাদের জাতীয় নেতা ও জাতীয় বীরদের গালাগাল করল। আখ্যায়িত করল তাদের বিশ্বাসঘাতক বলে। আমরা প্রতিবাদ করলাম। অবতীর্ণ হলাম তাদের সাথে এক উষ্ণতম কথা কাটাকাটিতে। মুখের কথা কাটাকাটিতে এই বিরোধের মীমাংসা হলো না- ঠিক হলো এর ফয়সালা হবে, মুষ্টিযুদ্ধের দ্ব›েদ্ব। বাঙালিদের জন্মগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে বক্সিং গøাবস হাতে তুলে নিলাম আমি। পাকিস্তানি গোঁয়ার্তুমির মান বাঁচাতে এগিয়ে এলো এক পাকিস্তানি ক্যাডেট, নাম তার লতিফ (পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অর্ডিন্যান্স কোরে এখন সে লেফটেন্যান্ট কর্নেল)। লতিফ প্রতিজ্ঞা করল, আমাকে সে একটু শিক্ষা দেবে।
এই মুষ্টিযুদ্ধ দেখতে সেদিন জমা হয়েছিল অনেক দর্শক। তুমুল করতালির মাঝে শুরু হলো মুষ্টিযুদ্ধ। বাংলাদেশ বনাম পাকিস্তানের দুই প্রতিনিধিদের মধ্যে। লতিফ আর তার পরিষদ দল অকথ্য ভাষায় আমাদের গালাগাল করল। হুমকি দিলো বহুতর। কিন্তু মুষ্টিযুদ্ধ স্থায়ী হলো না ত্রিশ সেকেন্ডের বেশি। পাকিস্তানপন্থী আমার প্রতিপক্ষ ধুলায় লুটিয়ে পড়ল। আবেদন জানালো সব বিতর্কের শান্তিপূর্ণ মীমাংসার জন্য।
বাঙালি অফিসার ও সৈনিকরা সব সময়ই পরিণত হতো পাকিস্তানি অফিসারদের রাজনৈতিক শিকারে। বড় বড় পদগুলো আর লোভনীয় নিয়োগপত্রের শিকাগুলো বরাবরই ছিঁড়ত পাকিস্তানিদের ভাগ্যে।
এরপর এলো আইয়ুবী দশক। আইয়ুব খানের নেতৃত্বে চালিত এক প্রতারণাপূর্ণ, সামরিক শাসনের কালো দশক। এই তথাকথিত উন্নয়ন সুপরিকল্পিত প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল বাঙালি সংস্কৃতিকে বিকৃত করার। আমাদের জাতীয়তা খাটো করার। বাংলাদেশের বীর জনতা অবশ্য বীরত্বের সাথে প্রতিহত করেছে এই হীন প্রচেষ্টা। এ ছিল এক পালাবদলের কাল।
১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হচ্ছে আর একটি উল্লেখযোগ্য বিষয়। সে সময়ে আমি ছিলাম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এমন এক কোম্পানিতে, যার নামে গর্ববোধ করত সবাই। আমি ছিলাম তেমনি একটা ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার। সেই ব্যাটালিয়ন এখন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীরও গর্বের বস্তু। খেমকারান রণাঙ্গনে বেদিয়ানে তখন আমরা যুদ্ধ করছিলাম। সেখানে আমাদের ব্যাটালিয়ন বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছিল। এই ব্যাটালিয়নই লাভ করেছিল পাক বাহিনীর মধ্যে দ্বিতীয় সর্বাধিক বীরত্ব পদক। ব্যাটালিয়নের পুরস্কার বিজয়ী কোম্পানি ছিল আমার কোম্পানি, ‘আলফা কোম্পানি’। এই কোম্পানি যুদ্ধ করেছিল ভারতীয় সপ্তদশ রাজপুত, ঊনবিংশ মারাঠা লাইট ইনফ্যান্ট্রি, ষোড়শ পাঞ্জাব ও সপ্তম লাইট ক্যাভালবির (সাঁজোয়া বহর) বিরুদ্ধে। এই কোম্পানির জওয়ানরা এককভাবে এবং সম্মিলিতভাবে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করেছে, ঘায়েল করেছে প্রতিপক্ষকে। বহু সংখ্যক প্রতিপক্ষকে হতাহত করে, যুদ্ধবন্দী হিসেবে আটক করে এই কোম্পানি অর্জন করেছিল সৈনিকসুলভ মর্যাদা, প্রশংসা করেছিল তাদেরও প্রীতি। যুদ্ধবিরতির সময় বিভিন্ন সুযোগে আমি দেখা করেছিলাম বেশ কিছু সংখ্যক ভারতীয় অফিসার ও সৈনিকের সাথে। আমি তখন তাদের সাথে কোলাকুলি করেছি, হাত মিলিয়েছি। আমার ভালো লাগত তাদের সাথে হাত মেলাতে। কেননা আমি তখন দেখেছিলাম তারাও অত্যন্ত উঁচুমানের সৈনিক। আমরা তখন মতবিনিময় করেছিলাম। সৈনিক হিসেবেই আমাদের মাঝে একটা হৃদ্যতাও গড়ে উঠেছিল, আমরা বন্ধুত্বে পরিণত হয়েছিলাম। এই প্রীতিই দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশের হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পাশাপাশি ভাইয়ের মতো দাঁড়িয়ে সংগ্রাম করতে উদ্বুদ্ধ করেছে আমাদের।
পাকিস্তানিরা ভাবত বাঙালিরা ভালো সৈনিক নয়। খেমকারানের যুদ্ধে তাদের বদ্ধমূল ধারণা ভেঙে চ‚র্ণবিচ‚র্ণ হয়ে গেছে। পাকিস্তানি বাহিনীর সবার কাছেই আমরা ছিলাম তখন ঈর্ষার পাত্র। সে যুদ্ধে এমন একটা ঘটনাও ঘটেনি যেখানে বাঙালি জওয়ানরা প্রাণের ভয়ে পালিয়ে গেছে। ভারতের সাথে সেই সংঘর্ষে বহু ক্ষেত্রে পাকিস্তানিরাই বরং লেজ গুটিয়ে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বেঁচেছে। সে সময় পাকিস্তানিদের সমন্বয়ে গঠিত পাক বাহিনীর এক প্রথম শ্রেণীর সাঁজোয়া ডিভিশনই নিম্নমানের ট্যাংকের অধিকারী ভারতীয় বাহিনীর হাতে নাস্তানাবুদ হয়েছিল, এসব কিছুতেই পাকিস্তানিরা বিচলিত হয়ে পড়েছিল। বাঙালি সৈনিকদের ক্ষমতা উপলব্ধি করে হৃৎকম্প জেগেছিল তাদের।
এই যুদ্ধে পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বাঙালি পাইলটরাও অর্জন করেছিল প্রচুর সুনাম। এসব কিছুই চোখ খুলে দিয়েছিল বাঙালি জনগণের, তারাও আস্থাশীল হয়ে উঠেছিল তাদের বাঙালি সৈনিকদের বীরত্বের প্রতি।
এসব কিছুর পরিণতিতে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা বাহিনী গ্রহণ করল এক গোপন পরিকল্পনা। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা ঠিক করল প্রতিরক্ষা বাহিনীতে বাঙালিদের আনুপাতিক হার কমাতে হবে। তারা তাদের এই গোপন পরিকল্পনা পুরোপুরিভাবে কার্যকর করল। কিন্তু এই গোপন তথ্য আমাদের কাছে গোপন ছিল না।
জানুয়ারিতে আমি নিযুক্ত হয়েছিলাম পাকিস্তান সামরিক অ্যাকাডেমিতে প্রশিক্ষকের পদে। যুদ্ধক্ষেত্রে সৈনিকদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আমি একদিন শিক্ষক হলাম। মনে রইল শুধু যুদ্ধের স্মৃতি।
সামরিক একাডেমিতে থাকাকালেও আমি সম্মুখীন হয়েছি শুধু নিকৃষ্ট অভিজ্ঞতার। সেখানে দেখেছি বাঙালি ক্যাডেটদের প্রতি পাকিস্তানিদের একই অবজ্ঞার ঐতিহ্যবাহী প্রতিচ্ছবি। অবৈধ উপায়ে পাকিস্তানিদের দেখেছি বাঙালি ক্যাডেটদের কোণঠাসা করতে। আমরা যখন ছাত্র ছিলাম তখন যেমন, আমি যখন শিক্ষক তখনো তেমনিভাবেই বাঙালি ক্যাডেটদের ভাগ্যে জুটত শুধু অবহেলা-অবজ্ঞা আর ঘৃণা।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর তথাকথিত সামরিক কর্মকর্তাদের সাথেও মাঝে মাঝে আমার আলোচনা হতো। তাদের পরিকল্পনা ছিল আরো কয়েক দশক কোটি কোটি জাগ্রত বাঙালিকে দাবিয়ে রাখার। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম, বাংলাদেশের জনগণ আর ঘুমিয়ে নেই। তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিচারের পরিণতিই ছিল এর জ্বলন্ত প্রমাণ। স্বাধীনতার জন্য আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের দিকে এটাও ছিল একটা সুস্পষ্ট অঙ্গুলি সঙ্কেত। এই মামলার পরিণতি এক করে দিলো বাঙালি সৈনিক, নাবিক ও বৈমানিকদের। বাংলাদেশের জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে গেল তারা। তাদের ওপর পাকিস্তান সরকারের চাপিয়ে দেয়া সব বিধিনিষেধ ঝেড়ে ফেলা হলো। এক কণ্ঠে সোচ্চার হলো তারা মাতৃভ‚মির স্বাধীনতার দাবিতে। ইসলামাবাদের যুদ্ধবাজদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা এবং অস্ত্র তুলে নেয়ার মধ্যেই যে আমাদের দেশের- বাংলাদেশের কল্যাণ নিহিত তাতে আর কোনো সন্দেহই ছিল না আমাদের মনে। এটাও আমাদের সশস্ত্র সংগ্রামের আরেক দিক দর্শন। এ সময় থেকেই এ ব্যাপারে আমরা মোটামুটিভাবে খোলাখুলি আলোচনাও শুরু করেছিলাম।
১৯৬৯ সালের এপ্রিল মাসে আমাকে নিয়োগ করা হলো জয়দেবপুরে। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের দ্বিতীয় ব্যাট্যালিয়নে আমি ছিলাম সেকেন্ড ইন কমান্ড। আমাদের কমান্ডিং অফিসার লে. কর্নেল আবদুল কাইয়ুম ছিল একজন পাকিস্তানি। একদিন ময়মনসিংহের এক ভোজসভায় ধমকের সুরে সে ঘোষণা করল বাংলাদেশের জনগণ যদি সদাচরণ না করে তাহলে সামরিক আইনের সত্যিকার ও নির্মম বিকাশ এখানে ঘটানো হবে। আর তাতে হবে প্রচুর রক্তপাত। এই ভোজসভায় কয়েকজন বেসামরিক ভদ্রলোকও উপস্থিত ছিলেন।
এরপর আমি বাংলাদেশে ফিরে এলাম। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে আমাকে নিয়োগ করা হলো চট্টগ্রামে। এবার ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড। এর কয়েক দিন পর আমাকে ঢাকা যেতে হয়। নির্বাচনের সময়টাই আমি ঢাকায় ছিলাম ক্যান্টনমেন্টে। প্রথম থেকেই পাকিস্তানি অফিসাররা মনে করত চ‚ড়ান্ত বিজয় তাদেরই হবে। কিন্তু নির্বাচনের দ্বিতীয় দিনেই তাদের মুখে দেখলাম হতাশার সুস্পষ্ট ছাপ। ঢাকায় অবস্থানকারী পাকিস্তানি সিনিয়র অফিসারদের মুখে দেখলাম আমি আতঙ্কের ছবি। শীঘ্রই জনগণ গণতন্ত্র ফিরে পাবে, এই আশায় আমরা বাঙালি অফিসাররা তখন আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠেছিলাম।
ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণোন্মুখ হয়ে উঠছিল, তখন আমি একদিন খবর পেলাম তৃতীয় কমান্ডো ব্যাট্যালিয়নের সৈনিকরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে বিহারীদের বাড়িতে বাস করতে শুরু করেছে।
এরপর এলো ১ মার্চ। সারা দেশে শুরু হলো ব্যাপক অসহযোগ আন্দোলন। এর পরদিন দাঙ্গা হলো। বিহারীরা হামলা করেছিল এক শান্তিপূর্ণ মিছিলে। এর থেকেই ব্যাপক গোলযোগের সূচনা হলো। এই সময়ে আমার ব্যাট্যালিয়নের এনসিওরা আমাকে জানালো, প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিংশতিতম বালুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা বেসামরিক পোশাক পরে বেসামরিক ট্রাকে করে কোথায় যেন যায়। তারা ফিরে আসে আবার শেষ রাতের দিকে। আমি উৎসুক হলাম। লোক লাগালাম খবর নিতে। খবর নিয়ে জানলাম প্রতি রাতেই তারা যায় কতগুলো নির্দিষ্ট বাঙালি পাড়ায়। নির্বিচারে হত্যা করে সেখানে বাঙালিদের। এই সময় প্রতিদিনই ছুরিকাহত বাঙালিদের হাসপাতালে ভর্তি হতেও শোনা যায়।
এই সময়ে আমাদের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জানজুয়া আমার গিতিবিধির ওপর লক্ষ রাখার জন্যও লোক লাগায়। মাঝে মাঝেই তার লোকেরা গিয়ে আমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করে। আমরা তখন আশঙ্কা করছিলাম, আমাদের হয়তো নিরস্ত্র করা হবে। আমি আমার মনোভাব দমন করে কাজ করে যাই এবং তাদের উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেয়ার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করি। এ সময় বাঙালি হত্যা ও বাঙালি দোকানপাটে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ক্রমেই বাড়তে থাকে।
আমাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করা হলে আমি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করব কর্নেল (তখন মেজর) শওকতও আমার কাছে জানতে চান। ক্যাপ্টেন শমসের মবিন এবং মেজর খালেকুজ্জামান আমাকে জানান যে, স্বাধীনতার জন্য আমি যদি অস্ত্র তুলে নেই তাহলে তারাও দেশের মুক্তির জন্য প্রাণ দিতে কুণ্ঠাবোধ করবেন না, ক্যাপ্টেন ওলি আহমদ আমাদের মাঝে এসব খবর আদান-প্রদান করতেন। জেসিও এবং এনসিওরাও দলে দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন স্থানে জমা হয়ে আমার কাছে আসতে থাকে। তারাও আমাকে জানায় যে, কিছু একটা না করলে বাঙালি জাতি চিরদিনের জন্য দাসে পরিণত হবে। আমি নীরবে তাদের কথা শুনতাম। কিন্তু আমি ঠিক করেছিলাম উপযুক্ত সময় এলেই আমি মুখ খুলব। সম্ভবত ৪ মার্চে আমি ক্যাপ্টেন ওলি আহমদকে ডেকে নেই। আমাদের ছিল সেটা প্রথম বৈঠক। আমি তাকে সোজাসুজি বললাম, সশস্ত্র সংগ্রাম করার সময় দ্রæত এগিয়ে আসছে। আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। ক্যাপ্টেন আহমদও আমার সাথে একমত হন। আমরা পরিকল্পনা তৈরি করি এবং প্রতিদিনই আলোচনা বৈঠকে মিলিত হতে শুরু করি।
৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ঘোষণা আমাদের কাছে এক গ্রিন সিগন্যাল বলে মনে হলো। আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চ‚ড়ান্ত রূপ দিলাম। কিন্তু তৃতীয় কোনো ব্যক্তিকে তা জানালাম না।
তারপর এলো সেই কালো রাত। একাত্তরের ২৫ ও ২৬ মার্চের মধ্যবর্তী কালো রাত। রাত ১টায় আমার কমান্ডিং অফিসার আমাকে নির্দেশ দিলো নৌবাহিনীর ট্রাকে করে চট্টগ্রাম বন্দরে গিয়ে জেনারেল আনসারীর কাছে রিপোর্ট করতে আমার সাথে নৌবাহিনীর (পাকিস্তানি) প্রহরী থাকবে তাও জানানো হলো। আমি ইচ্ছা করলে আমার সাথে তিনজন লোক নিয়ে যেতে পারি। তবে আমার সাথে আমারই ব্যাট্যালিয়নের একজন পাকিস্তানি অফিসারও থাকবে। অবশ্য কমান্ডিং অফিসারের মতে সে যাবে আমাকে গার্ড দিতে।
এ আদেশ পালন করা আমার পক্ষে ছিল অসম্ভব। আমি বন্দরে যাচ্ছি কি না তা দেখার জন্য একজন লোক ছিল। আর বন্দরে শবরীর মতো প্রতীক্ষায় ছিল জেনারেল আনসারী। হয়তোবা আমাকে চিরদিনের মতোই স্বাগত জানাতে।
এটা ছিল একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের চ‚ড়ান্ত সময়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি বললামÑ আমরা বিদ্রোহ করলাম। তুমি ষোলশহর বাজারে যাও। পাকিস্তানি অফিসারদের গ্রেফতার করো। ওলি আহমদকে বলো ব্যাট্যালিয়ন তৈরি রাখতে, আমি আসছি।
আমি নৌবাহিনীর ট্রাকের কাছে ফিরে এলাম। পাকিস্তানি অফিসার, নৌবাহিনীর চিফ পেটি অফিসার ও ড্রাইভারকে জানালাম যে, আমাদের আর বন্দরে যাওয়ার দরকার নেই।
এতে তাদের মনে কোনো প্রতিক্রিয়া হলো না দেখে আমি পাঞ্জাবি ড্রাইভারকে ট্রাক ঘুরাতে বললাম। ভাগ্য ভালো, সে আমার আদেশ মানল। আমরা আবার ফিরে চললাম। ষোলশহর বাজারে পৌঁছেই আমি গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে একটা রাইফেল তুলে নিলাম। পাকিস্তানি অফিসারটির দিকে তাক করে বললাম, হাত তোলো। আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম। সে আমার কথা মানল। নৌবাহিনীর লোকেরা এতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়ল। পর মুহূর্তেই আমি নৌবাহিনীর অফিসারের দিকে রাইফেল তাক করলাম। তারা ছিল আটজন। সবাই আমার নির্দেশ মানল এবং অস্ত্র ফেলে দিলো।
আমি কমান্ডিং অফিসারের জিপ নিয়ে তার বাসার দিকে রওনা দিলাম। তার বাসায় পৌঁছে হাত রাখলাম কলিং বেলে। কমান্ডিং অফিসার পাজামা পরেই বেরিয়ে এলো। খুলে দিলো দরজা। ক্ষিপ্রগতিতে আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম এবং গলাশুদ্ধ তার কলার টেনে ধরলাম।
দ্রæতগতিতে আর দরজা খুলে কর্নেলকে আমি বাইরে টেনে আনলাম। বললাম, বন্দরে পাঠিয়ে আমাকে মারতে চেয়েছিলে? এই আমি তোমাকে গ্রেফতার করলাম। এখন ল²ী সোনার মতো আমার সঙ্গে এসো।
সে আমার কথা মানল। আমি তাকে ব্যাট্যালিয়নে নিয়ে এলাম। অফিসারদের মেসে যাওয়ার পথে আমি কর্নেল শওকতকে (তখন মেজর) ডাকলাম। জানালাম, আমরা বিদ্রোহ করেছি। শওকত আমার হাতে হাত মেলালো।
ব্যাটালিয়নে ফিরে দেখলাম সব পাকিস্তানি অফিসারকে বন্দী করে একটা ঘরে রাখা হয়েছে। আমি অফিসে গেলাম। চেষ্টা করলাম লে. কর্নেল এম আর চৌধুরীর সাথে আর মেজর রফিকের সাথে যোগাযোগ করতে। কিন্তু পারলাম না। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। তারপর রিং করলাম বেসামরিক বিভাগের টেলিফোন অপারেটরকে। তাকে অনুরোধ জানালাম ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট, কমিশনার, ডিআইজি ও আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটালিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে তারা।
এদের সবার সাথেই আমি টেলিফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাউকে পাইনি। তাই টেলিফোন অপারেটরের মাধ্যমেই আমি তাদের খবর দিতে চেয়েছিলাম। অপারেটর সানন্দে আমার অনুরোধ রক্ষা করতে রাজি হলো।
সময় ছিল অতি মূল্যবান। আমি ব্যাটালিয়নের অফিসার, জেসিও আর জওয়ানদের ডাকলাম। তাদের উদ্দেশে ভাষণ দিলাম। তারা সবাই জানত। আমি সংক্ষেপে সব বললাম এবং তাদের নির্দেশ দিলাম সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। তারা সর্বসম্মতিক্রমে হৃষ্টচিত্তে এ আদেশ মেনে নিলো। আমি তাদের একটা সামরিক পরিকল্পনা দিলাম।
তখন রাত ২টা বেজে ১৫ মিনিট। ২৬ মার্চ। ১৯৭১ সাল। রক্তের আখরে বাঙালির হৃদয়ে লেখা একটি দিন। বাংলাদেশের জনগণ চিরদিন স্মরণ রাখবে এই দিনটিকে। স্মরণ রাখবে ভালোবাসবে। এই দিনটিকে তারা কোনো দিন ভুলবে না। কোনো-ন-দি-ন-না।