পৃষ্ঠাসমূহ

Thursday, August 17, 2017

চিরকুট

আমার অন্য একটি ব্লগের নাম চিরকুট।
চাইলে ঘুরে আসতে পারেন চিরকুট-এ।
অগ্রিম ধন্যবাদ।

Tuesday, August 15, 2017

বাংলাদেশে আক্রান্ত ইসলাম

মাহমুদুর রহমান

সম্পাদক, আমার দেশ



ক’দিন আগে অন্য একটি পত্রিকায় কর্মরত এক সিনিয়র রিপোর্টারের কাছ থেকে বাংলাদেশে ইসলামবিদ্বেষী মিডিয়ায় প্রচারণার এক বিস্ময়কর গল্প শুনেছি। একদিন পত্রিকাটির সম্পাদকমণ্ডলীর একজন নীতিনির্ধারক সেই রিপোর্টারকে ডেকে এদেশে ‘ইসলামী জঙ্গিবাদের’ পুনরুত্থানের ওপর জরুরি ভিত্তিতে একটা স্টোরি লিখতে নির্দেশ দিলেন। সাংবাদিকটি দেশের কোন জায়গায় নতুন করে এই জঙ্গিবাদের উত্থান হয়েছে, সেই তথ্য জানতে চাইলে সম্পাদক মহোদয় অগ্নিশর্মা হয়ে তাকে বললেন, জঙ্গি আছে কী নেই সেটা বিষয় নয়, স্টোরি লিখতে বলেছি, লিখে আনেন। বেচারা সিনিয়র রিপোর্টার বুঝতে পারলেন পেশাদার, ‘স্বাধীন’ সম্পাদক মহাশয় মালিকের নির্দেশ পালন করছেন মাত্র। পত্রিকার মালিকও হয়তো সরকারের ওপর মহল কর্তৃক বিশেষ উদ্দেশ্যে এ ধরনের প্রচারণা চালানোর জন্য নির্দেশিত হয়েছেন।
আমার পত্রিকা অফিসে বসে সেই সিনিয়র রিপোর্টার যেদিন এই ঘটনাটি বলছিলেন, তার আগের দিনেই চরম মুসলমানবিদ্বেষী এক মৌলবাদী খ্রিস্টান যুবক নরওয়ের রাজধানী অসলোতে গুলি চালিয়ে এবং বোমা ফাটিয়ে প্রায় একশ’ স্বদেশীকে হত্যা করেছে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী সে নাকি ইউরোপকে মুসলিম অধিগ্রহণ থেকে রক্ষা করার ‘মহান’ উদ্দেশ্যেই এই নৃশংস হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে। এই সন্ত্রাসী কাণ্ডের পর ‘সব মুসলমান সন্ত্রাসী নয়, তবে সব সন্ত্রাসী মুসলমান’, ভারত ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী গোষ্ঠী এবং আমাদের সুশীল (?)দের একাংশের এই প্রিয় তত্ত্বের কী হাল হবে, সেটি তারাই বিবেচনা করুক।
ইউরোপে সংঘটিত সন্ত্রাসী হামলা সম্পর্কে ইউরোপোল-২০০৯ প্রতিবেদন এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৬-২০০৮ সময়কালে ইউরোপে যতগুলো সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে, তার মধ্যে মাত্র ০.৪ শতাংশ মুসলিম উগ্রবাদী কর্তৃক পরিচালিত হয়। ২০০৬ সালে ৪৯৮টি ঘটনার মধ্যে মাত্র একটিতে, ২০০৭ সালে ৫৮৩টি ঘটনার মধ্যে ৪টিতে এবং ২০০৮ সালে ৫১৫টির মধ্যে শূন্যটিতে ইসলামিস্টরা জড়িত ছিল। প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ৯৯.৬ শতাংশ সন্ত্রাসী ঘটনার জন্য অমুসলিমরাই দায়ী।
আমার আজকের লেখার মূল বিষয়বস্তু বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিধায় পাশ্চাত্য নিয়ে কথা আর না বাড়িয়ে স্বদেশের দিকে দৃষ্টিপাত করছি। বর্তমান সেক্যুলার সরকারের আড়াই বছরে বাংলাদেশে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ও ঘৃণা ছড়ানোর লক্ষ্যে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় চরম নিন্দনীয় যে কাজ-কর্মগুলো করা হয়েছে, তার মধ্য থেকে কয়েকটির দিকে পাঠকের মনোযোগ আকর্ষণ করছি।

১. ২০০৯ সালের ২৮ মার্চ ‘সন্ত্রাস নিরসনে ধর্মীয় নেতাদের ভূমিকা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক সামীম মোহাম্মদ আফজাল বলেছেন, পৃথিবীতে যত সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ রয়েছে, তার সবই ইসলাম ও মুসলমানদের মধ্যে (!)। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানদের মধ্যে কোনো সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ নেই। হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টানরা সন্ত্রাসের সঙ্গে জড়িত নয়।

২. ২০০৯ সালের ১ এপ্রিল এদেশের আওয়ামীপন্থী শিল্পপতিদের অর্থে পরিচালিত সুশীল (?) থিংক ট্যাংক বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউট আয়োজিত ওয়ার্কশপে বক্তৃতায় বাংলাদেশের আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেছিলেন, কওমি মাদরাসাগুলো এখন জঙ্গিদের প্রজনন কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। কওমি মাদরাসাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ বিস্তার লাভ করেছে। এসব কওমি মাদরাসায় যে শিক্ষা দেয়া হয়, তা কূপমণ্ডূকতার সৃষ্টি করছে। ’৭৫-পরবর্তী সামরিক শাসনামলে বিভিন্ন সংশোধনী এনে ’৭২-এর সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতার চেতনাকে নস্যাত্ করার ফলেই এবং ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম ঘোষণার পর ধর্মের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ মাথাচাড়া দিয়েছে।  

৩. ২০০৯ সালের ২৩ এপ্রিল বরিশালের নিউ সার্কুলার রোডের এক বাড়িতে র্যাব হানা দিয়ে বোরকা পরে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য জড়ো হওয়ার অপরাধে ২১ নারীকে গ্রেফতার করে। র্যাব সাংবাদিকদের কাছে তাদের অভিযানের সংবাদ জানালে তা ফলাও করে ছাপা হয়। দিনভর জিজ্ঞাসাবাদ শেষে জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য না পেয়ে ২১ পরহেজগার নারীকে ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে চালান দেয়া হয়। ঘটনার দীর্ঘ ২ মাস পর ২৩ জুন আদালত তাদের বেকসুর খালাস দেন।

৪. ২০০৯ সালের ১৯ জুন রাজশাহীতে জঙ্গি সন্দেহে ১৫ নারী ও শিশুকে গ্রেফতার করা হয়। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ওইদিন বিকালেই মুচলেকা দিয়ে তাদের মুক্ত ঘোষণার পর আবার ৫৪ ধারায় গ্রেফতার দেখানো হয়। পুলিশ গ্রেফতারকৃতদের সম্পর্কে ব্যাপক তদন্ত করেও জঙ্গিসংশ্লিষ্টতার কোনো তথ্য পায়নি। শেষ পর্যন্ত আদালত তাদের বেকসুর খালাস দিলে জুলাই মাসের ১ তারিখে ১১ দিন কারাবাস শেষে ১৫ জন নিরপরাধ নাগরিক মুক্তি পান।  

৫. বোরকা পরার অপরাধে ২০০৯ সালের ৩ জুলাই পিরোজপুর জেলার জিয়ানগরে ছাত্রলীগের বখাটে কর্মীদের প্ররোচনায় পুলিশ জঙ্গি সন্দেহে তিন তরুণীকে গ্রেফতার করে। তারপর পুলিশের আবেদনের প্রেক্ষিতে আদালত তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তিন দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করলে তিন তরুণীকে ঢাকায় টিএফআই সেলে নিয়ে আসা হয়। ৫৪ ধারায় গ্রেফতারকৃত তরুণীদের বিরুদ্ধে মামলায় তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন অমর সিংহ। এ সময় তাদের বোরকা খুলতে বাধ্য করে মহাজোট সরকারের দিনবদলের পুলিশ। ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদেও কোনো জঙ্গি সংযোগের কাহিনী বানাতে ব্যর্থ হয়ে শেষ পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ফাইনাল রিপোর্ট দিতে বাধ্য হয়। দীর্ঘদিন কারাগারে বন্দি থেকে অবশেষে তিন অসহায়, নিরপরাধ তরুণী মুক্তি পান।

৬. ২০১০ সালের ৩ এপ্রিল সংবাদপত্রে খবর প্রকাশিত হয় যে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. একেএম শফিউল ইসলাম তার ক্লাসে ছাত্রীদের বোরকা পরার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন। তিনি ক্লাসে ‘মধ্যযুগীয় পোশাক বোরকা’ পরা যাবে না এবং এটি সমাজবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের কোনো পোশাক হতে পারে না বলে ফতোয়া জারি করেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, এটি বিভাগীয় কোনো সিদ্ধান্ত নয়, তবে আমার ক্লাসে কোনো ছাত্রীকে আমি বোরকা পরতে দেব না।  

৭. ২০১০ সালের ১ আগস্ট বিশ্ব শান্তি পরিষদের প্রেসিডেন্ট পরিচয়দানকারী জনৈক দেবনারায়ণ মহেশ্বর পবিত্র কোরআন শরিফের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করেন। রিট আবেদনে তিনি দাবি করেন, হজরত ইবরাহিম (আ.) তার বড় ছেলে ইসমাইল (আ.)কে কোরবানির জন্য নিয়ে গিয়েছিলেন বলে যে আয়াত পবিত্র কোরআন শরিফে রয়েছে, তা সঠিক নয়। তিনি দাবি করেন, হজরত ইবরাহিম তার ছোট ছেলে হজরত ইসহাক (আ.)কে কোরবানি করতে নিয়ে যান। এ বিষয়ে সঠিক ব্যাখ্যা ও কোরআনের আয়াত শুদ্ধ করার জন্য দেবনারায়ণ মহেশ্বর আদালতের কাছে প্রার্থনা করেন। আদালত রিট খারিজ করে দেয়ার পর দেবনারায়ণের এই চরম হঠকারী ও উস্কানিমূলক কর্মকাণ্ডে আদালতে উপস্থিত আইনজীবীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে পুলিশ দেবনারায়ণ মহেশ্বরকে কর্ডন সহকারে এজলাস থেকে বের করে তাদের ভ্যানে প্রটেকশন দিয়ে আদালত এলাকার বাইরে নিরাপদ অবস্থানে নিয়ে যায়।  

৮. বিচারপতি এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের দ্বৈত বেঞ্চ ২০১০ সালের ২২ আগস্ট স্বপ্রণোদিত (সুয়োমোটো) আদেশ প্রদান করেন যে, দেশের কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিসে বোরকা পরতে বাধ্য করা যাবে না। ‘নাটোরের সরকারী রাণী ভবানী মহিলা কলেজে বোরকা না পরলে আসতে মানা’ শিরোনামে ২২ আগস্ট একটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের বিচারপতিদ্বয় বোরকা পরিধানের বিরুদ্ধে সুয়োমোটো এই রায় দেন।

৯. ২০১১ সালের ২ জুন সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের অন্যতম নেতা মেজর জেনারেল (অব.) কে এম শফিউল্লাহ দাবি করেন, রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম, বিসমিল্লাহ ও ধর্মভিত্তিক রাজনীতি—এ তিনটির বিরুদ্ধে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। ওইদিন জাতীয় প্রেস ক্লাবের মতবিনিময় সভা থেকে ঘোষণা করা হয় যে, সংবিধানে বিসমিল্লাহ ও রাষ্ট্রধর্ম থাকলে হরতাল দেয়া হবে।

১০. ২০১১ সালের ৩০ জুন সংসদে পঞ্চদশ সংশোধনী গ্রহণ করে আমাদের সংবিধানের মূল নীতি থেকে আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস বাদ দিয়ে ধর্মনিরপেক্ষতা প্রতিস্থাপন করা হয়।

১১. ২০১১ সালের ১৪ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতৃভূমি টুঙ্গিপাড়া উপজেলার জিটি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ইংরেজি শিক্ষক শঙ্কর বিশ্বাস দশম শ্রেণীর ক্লাসে দাড়ি রাখা নিয়ে সমালোচনাকালে হজরত মোহাম্মদ (সা.)কে ছাগলের সঙ্গে তুলনা করেন। এতে ওই ক্লাসের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। পরে পুরো এলাকায় সাধারণ জনগণের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়লে শঙ্কর বিশ্বাস টুঙ্গিপাড়া থেকে পালিয়ে যান।

১২. ২০১১ সালের ২৬ জুলাই ধানমন্ডি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত সহকারী প্রধান শিক্ষক মদন মোহন দাস মহানবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) এবং পবিত্র হজ নিয়ে কটূক্তি করেন। সহকর্মী শিক্ষকদের সঙ্গে এক সভায় তিনি মন্তব্য করেন, ‘এক লোক সুন্দরী মহিলা দেখলেই বিয়ে করে। এভাবে বিয়ে করতে করতে ১৫/১৬টি বিয়ে করে। মুহাম্মদও ১৫/১৬টি বিয়ে করেছে। তাহলে মুসলমানদের মুহাম্মদের হজ করা স্থান মক্কায় গিয়ে হজ না করে ওই ১৫/১৬টি বিয়ে করা লোকের বাড়িতে গিয়ে হজ করলেই তো হয়।’

বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার অন্তত ৮৫ শতাংশ যে জন্মসূত্রে মুসলমান এ নিয়ে সম্ভবত বিতর্ক নেই। সেই দেশে আড়াই বছর ধরে অব্যাহতভাবে ইসলাম, কোরআন, হাদিস এবং মহানবী (সা.)কে কটাক্ষ করার অভ্যাস চর্চার ফলে ইসলামবিদ্বেষ এখন সরকারের সর্বত্র প্রায় দুরারোগ্য ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে এবং এই ব্যাধির ভাইরাস ক্ষমতাসীন মহলের সব পর্যায়ের লোকজন অকাতরে বিতরণ করে চলেছেন। ইউরোপে অসুস্থ ইসলামবিদ্বেষ সর্বব্যাপী হয়ে ওঠার বিষক্রিয়াতেই নরওয়েতে অ্যানডার্স বেরিং ব্রেইভিক (Anders Behring Breivik) নামক খ্রিস্টান মৌলবাদী ঘাতকের উত্থান ঘটেছে। দীর্ঘদিন ধরেই ইউরোপে ইসলাম, মুসলমান এবং আমাদের মহানবী (সা.)কে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের চর্চা চলছে। ডেনমার্কে হজরত মুহাম্মদ (সা.)কে নিয়ে সাম্প্রদায়িক কার্টুন ছাপা এবং বাকপ্রকাশের স্বাধীনতার নামে পাশ্চাত্যের জনগোষ্ঠীর এক বিরাট অংশের এই অতীব নিন্দনীয় কর্মকাণ্ডকে সমর্থনের ফলে জন্মলাভ করা বিষবৃক্ষের স্বাদ তারাই আজ আস্বাদন করছে।
নরওয়ের সুবুদ্ধিপূর্ণ রাজনীতিবিদরা অবশেষে স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছেন যে, এই ঘৃণ্য মানসিকতার আশু চিকিত্সা করা না হলে পশ্চিমের সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থা ভেঙে পড়ার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। মধ্যযুগের ইউরোপে এ-জাতীয় অন্ধ ধর্মীয় ঘৃণা ও বিদ্বেষ বিকশিত হওয়ার ফলেই তখন সেখানে যাজকদের নির্দেশে ডাইনি আখ্যা দিয়ে নারীদের পুড়িয়ে মারা হয়েছে এবং শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ইউরোপের দেশে দেশে চরমপন্থী খ্রিস্টানদের হাতে ইহুদি ধর্মাবলম্বীরা নিগৃহীত, অত্যাচারিত হয়েছে। ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির মতো করেই আজ পূর্ব ইউরোপে ইহুদি বিদ্বেষ এবং পশ্চিম ইউরোপে ইসলামবিদ্বেষ দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে। অসলো হত্যাকাণ্ডের তাত্ক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় ইসলামবিদ্বেষী পশ্চিমা মিডিয়া কর্তৃক এর দায়ভার কথিত ইসলামী জঙ্গির ঘাড়ে চাপানোর দুর্ভাগ্যজনক অপচেষ্টাও আমরা লক্ষ্য করেছি। ১৯৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওকলাহোমা সিটিতে এক ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় শত শত মার্কিন নাগরিক নিহত হলে সেখানেও প্রাথমিকভাবে মৌলবাদী মুসলমানদের দায়ী করা হয়েছিল। তার ক’দিনের মধ্যেই প্রকৃত ঘাতক মৌলবাদী খ্রিস্টান টিমোথি ম্যাকভেই (Timothy McVeigh)-এর নাম বিশ্ববাসী জেনে ফেলে।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের সর্বাধিক প্রচারিত সুশীল (?) বাংলা দৈনিকে মহানবী (সা.) এবং তাঁর সাহাবিকে কটাক্ষ করে ইউরোপের অনুরূপ ছড়া এবং কার্টুন ছাপা হলে দেশে উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। জেনারেল মইনের তত্কালীন জরুরি সরকারের উদ্যোগে বায়তুল মোকাররম মসজিদের খতিব উবায়দুল হকের কাছে উপস্থিত হয়ে পত্রিকাটির প্রখ্যাত ‘সেক্যুলার’ সম্পাদকের জোড় হস্তে ক্ষমাপ্রার্থনার ফলে সেই সময় ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের ক্ষোভ খানিকটা প্রশমিত করা সম্ভব হয়েছিল। বাস্তবতা হলো, আমাদের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতার ধ্বজাধারীদের হৃদয়ে গভীরভাবে প্রোথিত নরওয়ের ব্রেইভিকের সমতুল্য ইসলামবিদ্বেষ সময়-সুযোগমত জনসমক্ষে প্রকাশ পায়। মুখে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা প্রচার করলেও অন্তরে এদের অধিকাংশই চরমভাবে সাম্প্রদায়িক। এদের সাম্প্রদায়িকতা অবশ্য মূলত ইসলাম ধর্মবিরোধী। ইসলাম ছাড়া অন্য সব ধর্মমতের প্রতিই তাদের প্রগাঢ় শ্রদ্ধা। ২০০৮ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফের দাবি অনুযায়ী ডিজিএফআই’র কারসাজিতে মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হলে বাংলাদেশে চিহ্নিত ইসলামবিরোধী গোষ্ঠীর এদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের ধর্মের বিরুদ্ধে সুসংগঠিত আক্রমণ চালানোর সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হয়। গত আড়াই বছরে ইসলাম ধর্মের প্রতি ঘৃণা ছড়ানোর প্রাথমিক কিছু নমুনা আমরা দেখতে পেয়েছি।
বাংলাদেশের অধিকাংশ নাগরিক যে বর্তমান সরকারের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডে বীতশ্রদ্ধ হয়ে তাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়েছে, সেটি সম্ভবত নীতিনির্ধারকদের অজানা নয়। গত এক বছরের স্থানীয় সরকার পর্যায়ের সবক’টি নির্বাচনের ফলাফল বিশ্লেষণ করলে যে কোনো নিরপেক্ষ বিশ্লেষক নিশ্চিতভাবেই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হবেন যে, মহাজোট সরকারের পায়ের তলায় আর মাটি নেই। জনসমর্থনহীন শাসকশ্রেণী যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য স্বাভাবিকভাবেই ক্রমেই অতিমাত্রায় বিদেশনির্ভর হয়ে পড়ছে। দেশের স্বার্থ বিকিয়ে ভারতের সব অন্যায্য চাহিদা পূরণ করার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রতিবেশীর একমাত্র বিশ্বস্ত ও নির্ভরযোগ্য মিত্রে পরিণত হতে পেরেছেন। সুতরাং ধরে নেয়া যেতে পারে যে, ভারতীয় শাসককুল শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় আসীন রাখার জন্য যথাসম্ভব প্রচেষ্টা চালাবে।
লন্ডনের ‘ইকোনমিস্টে’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৮ সালের নির্বাচনেও ভারত মহাজোটকে টাকার থলি এবং এন্তার পরামর্শ দিয়ে নির্বাচনে জিততে সহায়তা করেছিল। আন্তর্জাতিক রাজনীতির বাস্তবতায় একমাত্র ভারতের সহযোগিতায় বাংলাদেশের জনমতের বিরুদ্ধে ক্ষমতায় টিকে থাকা যে সম্ভব নয়, সেটা শেখ হাসিনার মতো ঝানু রাজনীতিবিদ অবশ্যই বোঝেন। ২০০৮-এর পরিস্থিতির মতো ভারতের সমর্থনের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা বিশ্বের সমর্থন যুক্ত হলে দেশের জনগণকে তখন মহাজোটের আর তোয়াক্কা না করলেও চলবে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় অব্যাহত ইসলামবিরোধিতা সম্ভবত সেই সমর্থন আদায়েরই কৌশল।

বাংলাদেশে সীমিত পরিসরে জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটেছিল শেখ হাসিনারই আগের শাসনামলে। সেই দুর্ভাগ্যজনক ও চরম নিন্দনীয় জঙ্গিবাদও মাথাচাড়া দিয়েছিল আন্তর্জাতিক রাজনীতির প্রেক্ষাপটেই। আশির দশকে আফগানিস্তানে সোভিয়েট দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংগ্রামে কিছু বাংলাদেশী নাগরিকও যোগদান করেছিল। তারাই এদেশে মূলত জঙ্গিবাদের বীজ বহন করে নিয়ে এসেছে। এখানে উল্লেখ্য, সে সময় আফগানিস্তানের রণাঙ্গনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাশ্চাত্যের রাষ্ট্রগুলো তাদের আদর্শগত সোভিয়েটবিরোধিতার কারণে মুজাহিদদের পক্ষেই অবস্থান নিয়েছিল। ফলে আশির দশকে মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য ইসলামিক রাষ্ট্র থেকে স্বেচ্ছাসেবকরা আফগানিস্তানে সোভিয়েট দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে গেলে সাম্রাজ্যবাদী বিশ্ব তাতে সায় দিয়েছিল। ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়ার নির্বাচনে বিজয় লাভের ঠিক আগে নিউইয়র্কের টুইন টাওয়ারে বিমান হামলা বিশ্বরাজনীতির হিসাব-নিকাশ সম্পূর্ণ পাল্টে দেয়। বিশ্বব্যাপী জোরেশোরে কথিত ইসলামী জঙ্গিবাদবিরোধী প্রচারণা শুরু হলে বাংলাদেশও তার প্রভাবমুক্ত থাকতে পারেনি। কাকতালীয়ভাবে একই সময়ে বাংলাদেশে শায়খ আবদুর রহমান ও বাংলাভাইয়ের রাষ্ট্র ও ধর্মবিরোধী জঙ্গি কর্মকাণ্ড এবং তাদের উত্থানের প্রাথমিক পর্যায়ে তত্কালীন সরকারের মধ্যকার এক ধরনের নির্লিপ্ততা পশ্চিমের সঙ্গে বিএনপির নীতিনির্ধারকদের দূরত্ব সৃষ্টি করে। শেষপর্যন্ত বেগম খালেদা জিয়ার শাসনামলেই উভয় জঙ্গি নেতার গ্রেফতার ও তাদের বিচার সম্পন্ন হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর নীতিনির্ধারকরা তাতেও পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারেননি। যে কোনো বিচক্ষণ রাজনীতিবিদের মতোই শেখ হাসিনা প্রতিপক্ষের এই দুর্বলতার সুযোগ গ্রহণ করে প্রেসিডেন্ট বুশের কথিত সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ (war against terror)'র সঙ্গে প্রকাশ্যে একাত্মতা ঘোষণা করেন। সেই থেকে মার্কিন সমর্থন ধরে রাখার লক্ষ্যে শেখ হাসিনা তার ইসলামী জঙ্গি কার্ড অবিরাম খেলে চলেছেন। ফলে বাংলাদেশ আজ এমন একটি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, যেখানে ইসলামবিরোধী নগ্ন প্রচারণা কোনো ব্যতিক্রম নয়; বরং দৈনন্দিন অভিজ্ঞতা। যে সংবাদপত্রের ঘটনা দিয়ে আজকের মন্তব্য-প্রতিবেদন শুরু করেছি, তারাও সরকারের হুকুম তামিল করে চলেছেন মাত্র। উত্তরার র্যাব-১ হেডকোয়ার্টারে অবস্থিত টিএফআই সেলে রিমান্ডে থাকা অবস্থায় আমি নিজ চোখে শ্মশ্রুমণ্ডিত তরুণ এবং মধ্যবয়সীদের সেখানে আটক দেখতে পেয়েছি। তাদের গোঙানির শব্দ থেকে নির্যাতনের মাত্রাটাও খানিক আন্দাজ করতে পেরেছি। ক’দিন পরপর টেলিভিশনের পর্দায় ইসলামী জঙ্গি নাম দিয়ে যাদের আটক দেখানো হয়, তাদেরও হয়তো উপরের নির্দেশে প্রয়োজনমাফিক টিএফআই সেল মার্কা নির্যাতনকেন্দ্রগুলো থেকেই সরবরাহ করা হয়। এর মাধ্যমে মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে শেখ হাসিনা বাংলাদেশে ইসলামী জঙ্গি দমনে তার অপরিহার্যতা প্রমাণের চেষ্টা করছেন।
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত হস্তক্ষেপে নোবেল বিজয়ী প্রফেসর ইউনূসকে সরকার চরমভাবে অপমানিত করায় সরকারের সঙ্গে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের যে টানাপড়েন সৃষ্টি হয়েছে, নিয়মিতভাবে জঙ্গিনাটক মঞ্চায়নের মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের নীতিনির্ধারকরা সেই দূরত্ব কমানোর প্রাণপণ চেষ্টা করছেন। তাদের মূল লক্ষ্য সম্ভাব্য গৃহপালিত বিরোধীদলীয় নেতা এরশাদকে সঙ্গে নিয়ে আগামী ভোটারবিহীন একদলীয় নির্বাচনের আন্তর্জাতিক বৈধতা লাভ। ২০০৮ সালে নির্বাচনের মাত্র মাসখানেক আগে দেশে ফেরার সময় শেখ হাসিনা ওয়াশিংটনে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে তত্কালীন বুশ প্রশাসনকে প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়ে নির্বাচনে ফায়দা লাভে সমর্থ হয়েছিলেন। বাংলাদেশে আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে যাবে। সেই নির্বাচনে যিনিই প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হোন না কেন, এখানে শেখ হাসিনা তার গতবারের সফল ইসলামী জঙ্গি কার্ডই যে ব্যবহার করবেন, সেটা নিশ্চিত।
সাম্য ও শান্তির ধর্ম ইসলামে জঙ্গিবাদ যে সর্বতোভাবে পরিত্যাজ্য, এ নিয়ে ইসলামের প্রকৃত আদর্শে বিশ্বাসীদের মধ্যে কোনো মতবিরোধ নেই বলেই আমার ধারণা। কিন্তু একই সঙ্গে জালিম শাসকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোও একজন ঈমানদার মুসলমানের কর্তব্য। বাংলাদেশে কল্পিত ইসলামী জঙ্গিতত্ত্ব বিদেশে ফেরি করে যারা ক্ষমতায় টিকে থাকতে চাচ্ছেন, তাদের বিরুদ্ধে ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের ঐক্যবদ্ধ হয়েই মিথ্যা প্রচারণার জবাব দিতে হবে। ভারতীয় সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতায় বিমোহিত হয়ে যারা আমাদের সংবিধান থেকে আল্লাহর ওপর বিশ্বাস ও আস্থা সরিয়ে ফেলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন, তাদের নরেন্দ্র মোদীর গুজরাটের দিকে দৃষ্টিপাত করতে অনুরোধ জানাই। বাংলাদেশে আড়াই বছর ধরে যা ঘটে চলেছে, তার উল্টোটি গুজরাটে ঘটলে সেখানে অসহায় সংখ্যালঘুদের ভাগ্যে কী হতো, তার নমুনা ২০০২ সালে দেখা গেছে। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতা লেখা থাকলেই যে জনগণ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী হয় না, তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ প্রতিবেশী ভারত। অপরদিকে সংবিধানে বিসমিল্লাহ এবং আল্লাহর ওপর আস্থা ও বিশ্বাস লিপিবদ্ধ থাকলেই যে দেশের নাগরিকরা সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েন না, তার উজ্জ্বল উদাহরণ আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মিলে-মিশে থাকা বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর হাজার বছরের ঐতিহ্য। আশা করি, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ঘৃণ্য কৌশল হিসেবে ক্ষমতাসীনরা ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মাবরণে ইসলামবিরোধী সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তুলবেন না।

মুসলমানের মানবাধিকার থাকতে নেই

মাহমুদুর রহমান

সম্পাদক, আমার দেশ


বাড়ির পাশে মিয়ানমারে গত পঞ্চাশ বছর ধরে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত শুদ্ধি অভিযান (Ethnic Cleansing) চলছে। দেশটিতে সামরিক জান্তা এবং শান্তিতে নোবেল জয়ী, গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রামরত অং সাং সুচি’র মধ্যে তীব্র রাজনৈতিক বিরোধ থাকলেও মুসলমান নিধনে তারা একাট্টা। মহামতি গৌতম বুদ্ধের মহান বাণী ‘প্রাণী হত্যা মহাপাপ’ এবং ‘জগতের সকল প্রাণী সুখী হোক’ বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের বাইরেও বিশ্বের তাবত্ শান্তিবাদীদের আবেগাপ্লুত করে থাকে। অথচ মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ কট্টর সাম্প্রদায়িক বৌদ্ধ সম্প্রদায় সে দেশের রোহিঙ্গা মুসলমানদের মানুষ তো দূরের কথা গৌতম বুদ্ধ বর্ণিত জগতের যে কোনো প্রাণীর মর্যাদা দিতেও নারাজ। সংখ্যালঘু মুসলমানদের বিরুদ্ধে পরিচালিত শুদ্ধি অভিযানকে ন্যায্যতা দিতে অং সাং সুচিসহ মিয়ানমারের শাসক-গোষ্ঠী তাদের নাগরিকত্ব থাকা না থাকা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।আরব বণিকদের মাধ্যমে মিয়ানমারের জনগণ ১২শ’ বছর আগে ইসলাম ধর্মের সংস্পর্শে আসে। গত সহস্রাব্দের প্রথমার্ধে আরাকানের বৌদ্ধ রাজা বিদ্রোহীদের দ্বারা ক্ষমতাচ্যুত হলে তার অনুরোধে গৌড়ের সুলতান কয়েক দফায় সেখানে সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন।

১৪৩২ সালে গৌড়ের সেনাপতি সিন্দি খান আরাকানের প্রাচীন রাজধানী ম্রোহংয়ে মসজিদ নির্মাণ করেন। ওই সময় থেকেই বৃহত্তর চট্টগ্রাম এবং স্বাধীন আরাকান রাজ্যের জনগণের মধ্যে ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপিত হয়। আরাকানে মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং রাজসভায় বাংলাভাষা বিশেষ স্থান লাভ করে। মহাকবি আলাওল, শাহ ছগির, মাগন ঠাকুরের মতো মধ্যযুগের বিখ্যাত কবিরা আরাকান রাজ্যের পৃষ্ঠপোষকতা লাভ করেন। আরাকান রাজারা বৌদ্ধ ধর্ম চর্চা করলেও মুসলমান পোশাকি নাম গ্রহণ করেন। অর্থাত্ মিয়ানমারের আরাকান অংশে ইসলাম ধর্ম এবং বাংলা ভাষার বিস্তার লাভ ৬শ’ বছরেরও অধিককাল আগের ঘটনা। সে তুলনায় পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমাদের আগমন সেদিন ঘটেছে। অথচ মিয়ানমারে ওইসব মুসলমানের নাগরিকত্ব নিয়ে এই শতাব্দীতে এসে প্রশ্ন তোলা হচ্ছে। এদিকে সীমান্তের এ পারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের মদতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী একদল চিহ্নিত দালাল শ্রেণীর নাগরিক চাকমা জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী সাব্যস্ত করে এদেশের প্রকৃত ভূমিপুত্রদের অধিকার হরণের ষড়যন্ত্র চালিয়ে যাচ্ছে। মিয়ানমারে মুসলমানদের ওপর অমানবিক নির্যাতন চললেও তথাকথিত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় (International Community) নিশ্চুপ রয়েছে। জাতিসংঘ মিয়ানমারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের পরিবর্তে অধিক সংখ্যায় উদ্বাস্তু গ্রহণের জন্য বাংলাদেশের ওপর অন্যায় চাপ সৃষ্টি করে তাদের দায়িত্ব সেরেছে। বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন সরকারি মহল নিরাশ্রয় রোহিঙ্গা নারী-শিশুদের প্রতি যে চরম অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছে তার নিন্দা জানালেও এ কথা মানতে হবে, মিয়ানমারের মুসলমান শরণার্থীদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিলেই মূল সমস্যার সমাধান হচ্ছে না।
কয়েক লাখ রোহিঙ্গা দুই যুগেরও অধিককাল টেকনাফ অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ রাষ্ট্র। অর্থনৈতিকভাবে আমরা এখনও একটি পশ্চাদপদ দেশের নাগরিক। যৌক্তিক কারণেই আমাদের পক্ষে দীর্ঘস্থায়ীভাবে কোনো অতিরিক্ত জনগোষ্ঠীর ভার বহন করা সম্ভব নয়। জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং অন্যান্য পশ্চিমা দেশ বাংলাদেশের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে সচরাচর যে উত্কণ্ঠা, উত্সাহ দেখিয়ে থাকে তার কিয়দাংশ রোহিঙ্গাদের প্রতি প্রদর্শন করলে সমস্যাটির দীর্ঘমেয়াদি সমাধানে সহায়ক হতো। এসব রাষ্ট্র বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর আদিবাসী নামকরণে বাংলাদেশকে অব্যাহত অন্যায় চাপ দিলেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে তাদের নীরবতা বিস্ময়কর। এমন ধারণা পোষণ করা অমূলক হবে না, মিয়ানমারের সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী যদি মুসলমান ধর্মাবলম্বী হয়ে সংখ্যালঘু রোহিঙ্গারা ভিন্নধর্মের হতো তাহলে দ্বিমুখী চরিত্রের (Double Standard) পশ্চিমাদের সুর পাল্টে যেত। অবশ্য মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা কিছুদিন আগে মিয়ানমার সফরে এসে রোহিঙ্গাদের বিষয়ে অন্তত উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তার প্রকাশ্য প্রতিক্রিয়ার ফলে মিয়ানমার সরকার সাময়িকভাবে হলেও মুসলমান নির্যাতনে বিরতি দিয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো বিশ্বব্যাপী মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে গঠিত সংগঠন ওআইসি (OIC) তার দায়িত্ব পালনে ধারাবাহিক ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে চলেছে। রোহিঙ্গাদের পাশে এসে দাঁড়ানো তো দূরের কথা, জতিগত শুদ্ধি অভিযান পরিচালনার জন্য মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে একটা নিন্দা প্রস্তাবও এ নির্বিষ সংগঠনটি আনতে পারেনি। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে মুসলমানদের ওপর নিপীড়ন চললেও ওআইসির যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে অমার্জনীয় ব্যর্থতা সংগঠনটির কার্যকারিতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে।

এবার ফিলিস্তিনের নির্যাতিত জনগণের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। এক সময়ের ঔপনিবেশিক শক্তি ব্রিটেনের পররাষ্ট্র সচিব আর্থার জেম্স্ বালফুর (Arthur James Balfour) ১৯১৭ সালে তার দেশের ইহুদি (British Jewish Community) নেতা ব্যারন রথচাইল্ডকে (ইধত্ড়হ জড়ঃযংপযরষফ) লিখিত এক পত্রের মাধ্যমে প্যালেস্টাইনের আরব ভূমিতে একটি ইহুদি রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেন। ১৯৩৯ সালে যুদ্ধের ডামাডোল বাজার প্রাক্কালে ব্রিটেন ওই প্রতিশ্রুতি থেকে সরে আসার প্রচেষ্টা নিলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে বিশ্ব ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। ওই যুদ্ধে নাত্সী জার্মানি ও তার ফ্যাসিস্ট মিত্ররা পরাজিত হলে ইউরোপব্যাপী খ্রিস্টানদের মধ্যে ইহুদিদের প্রতি হলোকস্টজনিত (Holocaust) এক প্রকার যৌথ অপরাধবোধ (Collective Guilt) জন্ম নেয়। জার্মানি, পূর্ব ইউরোপ ও রাশিয়ার অধিকৃত অঞ্চলের ইহুদিদের প্রতি হিটলারের পৈশাচিক আচরণের সঙ্গে আরবের মুসলমানদের কোনোরকম সম্পৃক্ততা না থাকলেও যুদ্ধে বিজয়ী ইঙ্গ-মার্কিন জোট অসহায় ফিলিস্তিনিদের তাদেরই ভূখণ্ড থেকে উত্খাত করে সেখানে ইহুদিবাদী রাষ্ট্র (Zionist State) প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বালফুর ডিক্লারেশন বাস্তবায়ন করে। অভ্যন্তরীণ কোন্দলে জর্জরিত আরবরা সামরিক দুর্বলতা ও ইঙ্গ-মার্কিন ষড়যন্ত্রের ফলে ১৯৪৮ সালের আরব-ইসরাইল যুদ্ধে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। শুরু হয় ফিলিস্তিনিদের উদ্বাস্তু জীবন। তারপর ৬৪ বছর পেরিয়ে গেছে। ফিলিস্তিনিরা তাদের আপন আবাসে আজও ফিরতে পারেনি, পূর্বপুুরুষের ভূমিতে তাদের ন্যায্য অধিকারও ফিরে পায়নি। পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের অন্ধ সমর্থনে মৌলবাদী ইসরাইল এক দুর্বিনীত রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে। আন্তর্জাতিক আইনের কোনোরকম তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রটি ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে একের পর এক ভয়াবহ সব মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করে চলেছে। মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইল পারমাণবিক এবং অন্যান্য গণবিধ্বংসী অস্ত্রের সর্ববৃহত্ ভাণ্ডার গড়ে তুলেছে। অথচ সেদিকে দৃষ্টি না দিয়ে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার সম্পূর্ণ মিথ্যা অভিযোগে ইরাককে ধ্বংস করা হয়েছে। দীর্ঘদিনের অন্যায় অবরোধ ও নির্বিচারে বোমাবর্ষণে সে দেশের লাখ লাখ শিশু, নারী, পুরুষ নিহত হয়েছে। পশ্চিমাদের দ্বিমুখী নীতির এখানেই শেষ নয়। ইসলামিক রাষ্ট্র পাকিস্তানের পারমাণবিক বোমাকে পশ্চিমা মিডিয়ায় ‘ইসলামিক বোমা’ নামে উল্লেখ করা হলেও ইসরাইলের বোমাকে ‘ইহুদি বোমা’ কিংবা ভারতের বোমাকে ‘হিন্দু বোমা’ কখনও বলতে শুনিনি।


ফিলিস্তিনিদের প্রতি অর্ধ শতাব্দীরও অধিককাল ধরে এত নির্যাতন, এত অবিচার অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও আরব রাষ্ট্রগুলো ঐক্যবদ্ধ হওয়ার পরিবর্তে একে অপরের বিরুদ্ধে পশ্চিমাদের দ্বারা সোত্সাহে ব্যবহৃত হচ্ছে। ইরাক, লিবিয়া এবং সিরিয়ার বিরুদ্ধে হামলায় মার্কিন ও ন্যাটো বাহিনীর সঙ্গে বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রও যোগদান করেছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কুখ্যাত Divide and rule (বিভক্তি ও শাসন) কৌশল আজও নির্বোধ, ভ্রাতৃঘাতী মুসলমানদের বিরুদ্ধে সফলভাবে প্রয়োগ চলছে। ইরাক আক্রমণের প্রাক্কালে তত্কালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ (জুনিয়র) এবং যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার মুসলিম বিশ্বকে প্রতারিত করার জন্য যুদ্ধ শেষে ফিলিস্তিনি সমস্যার আশু সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। ইরাক- ধ্বংসযজ্ঞের প্রায় দশ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। রাজনীতিতে কপটতার জন্য বহুল পরিচিত টনি ব্লেয়ার অসংখ্য মুসলমানের রক্তমাখা হাত নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে জাতিসংঘের বিশেষ দূত হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। তার বেতন কত কিংবা তাকে অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা প্রদানে বছরে জাতিসংঘের কত লাখ ডলার ব্যয় হয় সে সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা নেই। তবে অর্থের অংকটি বিশাল না হলে টনি ব্লেয়ার তার ‘মূল্যবান’ সময় নষ্ট করে মুসলমানদের প্রতি বদান্যতা দেখাচ্ছেন এটা বিশ্বাস করা কঠিন। ইরাকের লাখো শিশু হত্যাকারী টনি ব্লেয়ারকে মধ্যপ্রাচ্যে এ দায়িত্ব প্রদান করাটাই বিশ্বের সব মুসলমানের জন্য চরম অবমাননাকর। আশ্চর্যের বিষয় হলো আজ পর্যন্ত জাতিসংঘের সদস্য কোনো ইসলামিক রাষ্ট্রই টনি ব্লেয়ারের পদ প্রাপ্তি নিয়ে আপত্তি জানায়নি। যাই হোক, টনি ব্লেয়ার এখন পর্যন্ত ফিলিস্তিনি সমস্যার সমাধানে কোনোরকম অবদান রাখতে পারেননি। সমস্যা সমাধানে তার আদৌ কোনো আগ্রহ আছে সেটাও প্রতিভাত হয়নি। বরঞ্চ, এ সময়ের মধ্যে ফিলিস্তিনের বিরুদ্ধে ইসরাইলের আগ্রাসন আরও তীব্র হয়েছে। প্রায় প্রতিদিন ফিলিস্তিনি নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু নিহত হচ্ছে। এই একতরফা গণহত্যাকে পশ্চিমাবিশ্ব জায়নবাদী ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকার বলে বর্ণনা করে বৈধতা দিচ্ছে। সুতরাং, আরব বিশ্বের একতা ব্যতীত সে অঞ্চলের মুসলমানদের সাম্রাজ্যবাদের নির্যাতন থেকে মুক্তির কোনো সম্ভাবনা নেই।

কাশ্মীর নিয়ে আলোচনা ছাড়া আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মুসলমানের বঞ্চনার কাহিনী সমাপ্ত হতে পারে না। ১৯৪৭ সালে ভারত উপমহাদেশ বিভক্ত হয়েছিল সংখ্যা-সাম্যের ভিত্তিতে। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত হয়। কিন্তু, কাশ্মীর এবং হায়দরাবাদের মতো কয়েকটি রাজাশাসিত অঞ্চলের (Princely state) ভাগ্য অসত্ উদ্দেশে অনির্ধারিত রেখেই ব্রিটিশরা ভারত ত্যাগ করে। কাশ্মীরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ মুসলমান হলেও ডোগরা রাজা ছিলেন হিন্দু। অপরদিকে হায়দরাবাদের পরিস্থিতি ছিল সম্পূর্ণ উল্টো। ভারত সরকার হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তিতে সেনা অভিযান চালিয়ে মুসলমান শাসক নিজামকে ক্ষমতাচ্যুত করে হায়দরাবাদ দখল করে। একই যুক্তিতে কাশ্মীর পাকিস্তানের অংশভুক্ত কিংবা স্বাধীন হওয়ার কথা থাকলেও হিন্দু রাজা অন্যায়ভাবে ভারতভুক্তির ঘোষণা দেন। ১৯৪৮ সালের ২১ এপ্রিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে ৩৯-৫ সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ৪৭ নম্বর প্রস্তাব (Resolution 47) গৃহীত হয়। কাশ্মীরের ভবিষ্যত্ নির্ধারণে সেখানকার জনগণের অধিকার মেনে নিয়ে ওই প্রস্তাবে গণভোটের (Plebiscite) সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে জাতিসংঘের প্রস্তাবে একটা ফাঁক থেকে যায়। জাতিসংঘ চ্যাপ্টারের ৭ (Chapter VII)-এর পরিবর্তে নিরাপত্তা পরিষদ চ্যাপটার ৬ (Chapter VI)-এর অধীনে প্রস্তাব গ্রহণ করে। চ্যাপ্টার ৭-এর প্রয়োগ হলে ওই সিদ্ধান্ত ভারতের ওপর বাধ্যতামূলক (Binding and enforceable) হতো। সে সময় ভারত সরকার নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাব বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও আন্তর্জাতিক আইনের ওই ফাঁকফোকরের সুযোগ নিয়ে সম্পূর্ণ গায়ের জোরে কাশ্মীরের জনগণকে আজ পর্যন্ত ভবিষ্যত্ নির্ধারণের অধিকার প্রয়োগ করতে দেয়নি। ভারতীয় সাম্রাজ্যবাদের বুটের তলায় নিষ্পেষিত হচ্ছে সেখানকার নারীর সম্ভ্রম, তরুণের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ৬৫ বছরের সংগ্রামে কাশ্মীরের লাখ লাখ স্বাধীনতাকামী নারী-পুরুষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়েছে, নিহত হয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আমাদের ওপর যে আচরণ করেছে তার সঙ্গে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর আচরণের কোনো ফারাক নেই। ৯০-এর দশকে কাশ্মীরের তত্কালীন গভর্নর জগমোহন বিক্ষোভকারীদের দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দিয়ে এক সময়ের ভূস্বর্গকে মৃত্যুপুরিতে পরিণত করেছিলেন। সেখানে পাঁচ লক্ষাধিক ভারতীয় সেনা শতাধিক নির্যাতন কেন্দ্র পরিচালনা করে স্বাধীনতা অর্জনের লক্ষ্যে সংগ্রামরত মুক্তিযোদ্ধাদের নির্যাতন করে চলেছে। ১ কোটি ২৫ লাখ জনসংখ্যার একটি অঞ্চলে ৫ লাখ সেনা মোতায়েন থেকেই ভারত সরকারের শক্তি প্রদর্শনের আন্দাজ পাওয়া সম্ভব। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশীকে দমন করতে পাকিস্তান সরকার ১ লাখ সেনা পাঠিয়েছিল। ফিলিস্তিনের নিপীড়িত মানুষের মতো কাশ্মীরের জনগণেরও মুক্তি কবে আসবে সেই ভবিষ্যদ্বাণী আমার পক্ষে করা সম্ভব না হলেও স্বাধীনতার অদম্য আকাঙ্ক্ষা যে কোনোদিন নির্বাপিত করা যায় না সেটা ইতিহাসেরই শিক্ষা।

এবার মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ এক রাষ্ট্রে মুসলমানদেরই অসহায়ত্বের কথা বলি। সেক্যুলারত্বের আবরণে এক ইসলাম বিদ্বেষী সরকারের আমলের বাংলাদেশে সংখ্যাগুরু নাগরিকদের মানবাধিকার পরিস্থিতির চিত্র সংক্ষেপে তুলে ধরে লেখার ইতি টানব। তিনটি ঘটনার উল্লেখ করলেই আশা করি, পাঠক দেশের সার্বিক অবস্থা বুঝতে পারবেন। বিশ্বজিত্ নামে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক খেটে খাওয়া নিরীহ তরুণ প্রকাশ্য দিবালোকে মুজিববাদী ছাত্রলীগের চাপাতি বাহিনীর নৃশংসতার শিকার হয়ে এই বিজয়ের মাসেই নিহত হয়েছে। ছেলেটিকে লাঠি দিয়ে প্রহার এবং চাপাতি দিয়ে কোপানোর দৃশ্য টেলিভিশনের পর্দায় শেষ পর্যন্ত দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হয়নি। এই লেখার সময়ও তার উদভ্রান্ত, রক্তাক্ত চেহারা চোখের সামনে ভাসছে। প্রধানমন্ত্রী এবং তার মন্ত্রিসভার চাটুকার বাহিনী ব্যতীত দলমত নির্বিশেষে দেশবাসী সরকারের খুনি বাহিনীর বর্বর, নৃশংস আচরণে ঘৃণা প্রকাশ করেছেন। বিশ্বজিতের হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য দেখতে গিয়ে আমার ২০০৭ সালের ২৮ অক্টোবরে ঢাকার রাস্তায় লগি-বৈঠার তাণ্ডবের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেদিন জামায়াত-শিবিরের একাধিক তরুণ আজকের বিশ্বজিতের মতোই অগুনতি টেলিভিশন ক্যামেরা এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অসংখ্য সদস্যের চোখের সামনে নিহত হয়েছিলেন। দেশবাসী লাশের উপর আওয়ামী সন্ত্রাসীদের তাণ্ডব নৃত্যের একটি অতি লোমহর্ষক দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিলেন। হত্যাকারীরা একই দলভুক্ত ছিল। আজকে তাদের মাঠে নামার হুকুম দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহীউদ্দীন খান আলমগীর আর সেদিন হুকুম দিয়েছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। ঘটনার প্রকৃতি এবং হুকুমদাতার পরিচয়ে তফাত্ সামান্যই। কিন্তু, বড় তফাত্ হলো ২৮ অক্টোবর যারা নিহত হয়েছিলেন তারা সবাই ধর্মে মুসলমান ছিলেন। মুসলমান প্রধান দেশে সেই নৃশংসতায় বিস্ময়করভাবে বিবেক জাগ্রত না হলেও আজ বিশ্বজিতের জন্য সবাই আহাজারি করছেন। বিদেশি কূটনীতিকরাও দেশবাসীর উদ্বেগে শামিল হয়েছেন। আচ্ছা, ২৮ অক্টোবর লগি-বৈঠার তাণ্ডবে যারা নিহত হয়েছিলেন তাদের নামগুলোও কি স্মরণে আছে আপনাদের? এ সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় টকশো স্টার মাহমুদুর রহমান মান্না ক’দিন আগে টেলিভিশনে বললেন বিশ্বজিতের ঘটনা নাকি বেশি নির্মম। হতেও পারে। তবে আমার কাছে হিন্দু ও মুসলমানের রক্তের রঙ, তাদের মৃত্যুযন্ত্রণা একই রকম মনে হয়। প্রসঙ্গক্রমে আরও একটি তথ্যের উল্লেখ করছি। যেদিন ঢাকায় বিশ্বজিত্ নিহত হয়েছে সেই একইদিনে সিরাজগঞ্জে, জামায়াতে ইসলামীর কর্মী ওয়ারেস আলীকেও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা গণপিটুনিতে হত্যা করেছে। সেই খুনের ঘটনাতেও নৃশংসভাবে লাঠি এবং ছুরি ব্যবহৃত হয়েছে। বিস্ময়ের ব্যাপার হলো বিশ্বজিত্ হত্যা নিয়ে মিডিয়াতে মাতামাতি হলেও ওয়ারেস আলীর খবর ছাপাতে পত্রিকায় সিঙ্গেল কলামের বেশি জায়গা হয়নি। তাও আবার হাতে গোনা দু-একটি পত্রিকায়। অধিকাংশ পত্রিকা এবং টেলিভিশন ওয়ারেস আলীকে সংবাদের মর্যাদা দিতেও কুণ্ঠিত হয়েছে।

পরাগ নামে এক নিষ্পাপ শিশু কিছুদিন আগে স্কুলে যাওয়ার পথে অপহৃত হয়েছিল। শিশুটির বাবা কেরানীগঞ্জের একজন ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। কয়েকদিন নিখোঁজ থাকার পর বিশাল অংকের মুক্তিপণের বিনিময়ে পরাগকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়। পরাগের পরিবার সংখ্যালঘু এবং আওয়ামী লীগ সমর্থক। অপহরণকারীরাও সরকারি দলের চিহ্নিত সন্ত্রাসী। পরাগের অপহরণে সারা দেশে শোকের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। আমার পরিচিত অনেক পরিবারে শিশুটির মুক্তির জন্য নামাজ পড়ে দোয়া করার কাহিনী শুনেছি। ক’দিন অন্তত টেলিভিশনে প্রায় ২৪ ঘণ্টাই কেবল পরাগকে নিয়ে সংবাদ প্রচার এবং টক শো’তে আলোচনা চলেছে। অপহরণকারীরা তাকে মুক্তি দিলে দেশের মানুষ আন্তরিকভাবেই স্বস্তি প্রকাশ করেছে। ধনবানদের জন্য নির্মিত স্কয়ার হাসপাতালে চিকিত্সা শেষে পরাগ নিজ বাসায় মায়ের কোলে ফিরে গেলে এলাকায় আনন্দের বন্যা বয়ে গিয়েছিল। উলুধ্বনি, ফুল ছিটানো, মিষ্টি বিতরণ, ইত্যাদি টেলিভিশনে দেখেছি। পরাগের মতোই এবার আর এক শিশুর গল্প বলি। সে এতই দরিদ্র পরিবারের যে তার নাম জানার আপনাদের কারও আগ্রহ হবে না। পঞ্চগড়ে এক অনুষ্ঠানে গিয়ে তার হত্যার নির্মম কাহিনী শুনেছিলাম। শিশুটির বাবা কলা ফেরি করে সংসার চালান। দু’বেলা আহার জোটা মুশকিল। অপহরণকারীরা শিশুটিকে তুলে নিয়ে এক লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেছিল। হাজার টাকা দেয়ার যার সামর্থ্য নেই সে লাখ টাকা কোথায় পাবে? ক্লাস থ্রিতে পড়া মাসুম বাচ্চাটিকে নরপিশাচরা বড় নির্মমভাবে হত্যা করে রাস্তার পাশে ডোবায় লাশ ফেলে গিয়েছিল। আমি যে অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম সেটা আমার সংবর্ধনা সভা ছিল। কিন্তু, সংবর্ধনা সভা পরিণত হয় শোক সভায়। সভাস্থলে উপস্থিত গ্রামের মহিলাদের বুকফাঁটা কান্নায় পরিবেশ ভারি হয়ে উঠেছিল; আমার মতো পাষাণ হৃদয়ও চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। এই হতদরিদ্র, মুসলমান পরিবারের অভাগা সেই শিশুর করুণ কাহিনী কোনো টেলিভিশন চ্যানেলে সবিস্তারে বর্ণনা হতে কি কেউ দেখেছেন? পঞ্চগড়ের দরিদ্র বাবা-মা প্রাণের চেয়ে প্রিয় শিশুটিকে হারিয়ে কেমন করে শোকাতুর জীবন কাটাচ্ছেন আমিও তার খবর রাখিনি। তারা বেঁচে আছেন কিনা তাও জানি না।
ক’দিন আগে ২১ জন নারীকে কয়েকশ’ বীরপুঙ্গব পুরুষ পুলিশ কয়েক ঘণ্টা ‘অপারেশন’ চালিয়ে মগবাজারের এক বাসা থেকে গ্রেফতার করে রমনা থানায় নিয়ে যায়। তাদের কাছ থেকে ‘ভয়ঙ্কর’ সব ইসলামী বইপত্র উদ্ধার করা হয়েছে যা কিনা আওয়ামী পুলিশের দৃষ্টিতে বন্দুক বোমার চেয়েও প্রাণঘাতী। একরাত থানা হাজতে রেখে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত সেই তরুণীদের সিএমএম আদালতে নেয়া হয়। ম্যাজিস্ট্রেট ২০ জনের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে দু’দিনের রিমান্ড প্রেরণ করেন। মামলা কিন্তু দায়ের হয়েছিল ৫৪ ধারায় যাতে রিমান্ড তো দূরের কথা তত্ক্ষণাত্ জামিন মঞ্জুর হওয়া উচিত ছিল। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা ২০ বছরের কান্তাকে অবশ্য ম্যাজিস্ট্রেট দয়া দেখিয়ে রিমান্ডের পরিবর্তে জেলহাজতে পাঠিয়ে দেন। তবে কান্তাকে ম্যাজিস্ট্রেটের আট তলার এজলাসে সিঁড়ি দিয়ে হাঁটিয়ে, টেনে-হিঁচড়ে ওঠানো এবং নামানো হয়। সিএমএম আদালতে লিফ্ট থাকলেও কান্তাকে সেটা ব্যবহার করতে দেয়া হয়নি। আমি যে বিশেষ ধরনের ক্ষ্যাপাটে কিসিমের মানুষ সে তথ্য তো দেশবাসী শেখ হাসিনার আমলে জেনে গেছেন। এতগুলো নিরপরাধ নারীকে রিমান্ডে পাঠানোর বিষয়টি জানার পর থেকে একটা প্রশ্ন মাথার ভেতরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যে পুলিশ কর্মকর্তা রিমান্ড চেয়েছেন এবং সিএমএম আদালতের যে ম্যাজিস্ট্রেট তা মঞ্জুর করেছেন তাদের এসব দুষ্কর্ম করার সময় কখনও কি নিজ স্ত্রী, বোন অথবা কন্যার কথা মনে পড়ে? চাকরি বাঁচানোর দোহাই দিয়ে বিবেককে কি এভাবে কবর দেয়া সম্ভব? অফিস শেষে নিজগৃহে ফিরে স্ত্রী কিংবা বোন কিংবা কন্যার দিকে তাকানোর সময় তাদের দৃষ্টি কি লজ্জায় নত হয়ে আসে না?
যাই হোক, দু’দিন রিমান্ড শেষে পর্দানশীন ২০ নারীকে জেলহাজতে পাঠানো হয়েছে। এদের মধ্যে অনেকের বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা চলছে। প্রস্তুতি নেয়ার জন্য তাদের পাঠ্যবই পাঠানো হলেও জেল কর্তৃপক্ষ সেগুলো আটকে দিয়েছে। বাংলাদেশে প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী উভয়ই নারী। সেক্যুলার সরকারের সর্বত্র প্রগতিশীল নারীবাদীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের চেয়ারপার্সন সুলতানা কামাল অন্য সব ব্যাপারে সরব হলেও এ বিষয়ে এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি। আর এক মানবাধিকার কর্মী অ্যাডভোকেট এলিনা খানের কাছে মন্তব্যের জন্য আমার দেশ থেকে ফোন করা হলে কথা বলতে শুরু করেও বন্দী নারীরা সবাই জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রী সংগঠনের সদস্য জানা মাত্রই রূঢ় কণ্ঠে বলে উঠেছেন, আমার কোনো প্রতিক্রিয়া নেই। ক্যামেরার সামনে বিচিত্র অঙ্গভঙ্গিতে নাটক করতে পারঙ্গম, মানবাধিকার কমিশনের আওয়ামী চেয়ারম্যান ড. মিজানুর রহমান লিমনকে নিয়ে কান্নাকাটি করলেও এক্ষেত্রে নীরব। অবশ্য কথা বলেননি, ভালোই হয়েছে। বন্দিনীদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে হয়তো নির্লজ্জের মতো বলে বসতেন, মাত্র দু’দিনের রিমান্ড অনেক কম হয়ে গেছে, এখনও ডাণ্ডাবেড়ি কেন পরানো হয়নি, বিনাবিচারে ফাঁসি দেয়া হচ্ছে না কেন, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সমাজের এই ভয়াবহ চিত্র চরম ফ্যাসিবাদের লক্ষণ। জার্মানির হিটলার তার নাত্সীবাদী শাসনকালে ইহুদিদের বসবাসের জন্য বস্তির (Ghetto) ব্যবস্থা করেছিলেন, সহজে চেনার জন্য সব ইহুদি নাগরিকের বাহু বন্ধনী (Arm band) লাগানো বাধ্যতামূলক করেছিলেন। সেক্যুলারিজমের নামে বাংলাদেশের নব্য ফ্যাসিস্টরা প্রায় সেদিকেই ধাবিত হচ্ছেন বলেই মনে হচ্ছে।

বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক নাকি মুসলমান ধর্মাবলম্বী! অবস্থাদৃষ্টে এই তথ্যে বিশ্বাস করা ক্রমেই কষ্টকর হয়ে উঠছে। আরবি নামে কেউ পরিচিত হলেই তাকে কি মুসলমান বলা যাবে? আরবে নাম শুনে কারও ধর্ম বিশ্বাস সম্পর্কে ধারণা করা কঠিন। খ্রিস্টান, ইহুদি, মুসলমানদের প্রায় কাছাকাছি নাম। লেবাননের প্রখ্যাত দার্শনিক, লেখক, কবি, চিত্রকর কাহলিল জিবরানকে দীর্ঘদিন আমি মুসলমান বলেই জানতাম। প্রায় বুড়ো বয়সে আমার সেই ভুল ভেঙেছে। বাংলাদেশেও প্রকৃত মুসলমানরা নীরবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছেন কিনা সেটা জানার জন্য বোধহয় সমীক্ষার সময় এসেছে। ফেরদৌস, নুর, শরীফ, কবীর, আলী, আহমেদ, হক, রহমান ইত্যাদি নামের আড়ালে কারা লুকিয়ে আছেন কে জানে?
ইমেইল : admahmudrahman@gmail.com

ভাষা-রেনেসাঁস ধর্ম-রেনেসাঁসের চেয়ে উন্নত ঘটনা

আবুল বাশার

(ভারতের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক)

 

অন্নদাশঙ্কর রায় দুটি রেনেসাঁসের কথা বলেন। একটি শহর কলকাতাকেন্দ্রিক বিদ্যাসাগরীয় রেনেসাঁস। অন্যটি ঢাকাকেন্দ্রিক মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন (রেনেসাঁস)। বিদ্যাসাগরীয় রেনেসাঁস প্রধানত বাঙালি হিন্দু জীবনের রেনেসাঁস। সেই রেনেসাঁস সব স্তরের হিন্দু জীবনকে স্পর্শ করতে পারেনি। উচ্চবর্ণ-উচ্চবর্গের হিন্দুই তাতে লাভবান হয়েছেন। নিম্নবর্ণ-নিম্নবর্গের হিন্দুর জীবনে ওই রেনেসাঁস তেমন কোনো কাজে লাগেনি।
বলাবাহুল্য বাংলার মুসলমান জীবনে ওই আন্দোলন সামান্যও রেখাপাত করেনি। করবার হেতুও কিছু ছিল না। বিদ্যাসাগরের যে সমাজ সংস্কার আন্দোলন, তা বস্তুত ধর্ম সংস্কারও বটে। বিধবা বিবাহ প্রচলন করার যে বিদ্যাসাগরীয় আন্দোলন, সেই আন্দোলন বাংলার মুসলমানকে স্পর্শ করবে কোন যুক্তিতে?
মুসলমান জীবনে ‘বিধবা সমস্যা’ বলে কোনো সমস্যা কোনো কালে ছিল না। কোনো কালেই নেই। মহানবী হযরত মহম্মদ (স.) তাঁর দাম্পত্য জীবন শুরুই করেছিলেন বিধবা মহামানবী খদিজাকে বিয়ে করে—মহাত্মা হযরত মহম্মদের তুলনায় আলোর মহিলা খদিজা অন্তত ১৫ বছরের বড় ছিলেন।
আরবে বিধবা কোনোকালেই সমস্যা নয়। মুসলমান জীবনে সতীদাহ নামে কোনো প্রথা কোনোকালে ছিল না। দেখা যাচ্ছে এই দুই সমস্যাও সর্বস্তরের হিন্দু জীবনের সমস্যা ছিল না। অথচ সারাটা বাংলা সাহিত্য এই বিধবা সমস্যা ও বিধবা প্রেমেই জর্জরিত। বাংলা সাহিত্যের বাঁক বদল হয়েছে এই বিধবার প্রেমে (চোখের বালি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর)।
শরত্চন্দ্র বিরাট আক্ষেপ করেছেন এই বলে যে, বিধবা সমস্যা নিয়ে সাতিশয় একা লড়তে হয়েছিল বিদ্যাসাগরকে—কেউ তাঁর পাশে ছিল না। কোনা লেখক বিদ্যাসাগরকে সমর্থন করেননি। এমনকী শরত্চন্দ্র এ কথাও বলছেন যে, ধর্মীয় সংস্কারের বিরোধিতা করে কিছু লিখলে তাতে যে সৌন্দর্য সৃষ্টি হয়, তা মানুষ নিতে পারে না। বিধবা প্রেম কতজন হিন্দুর ভালো লাগত, তা ভাববার কথা।
তবু দেখা যাচ্ছে, বিদ্যাসাগরই জিতলেন, শরত্চন্দ্রের সাহিত্য কালজয়ী হলো। হিন্দু সমাজের অগ্রবর্তী বর্ণ ও বর্গকে ঘিরে গড়ে উঠল একটি মধ্যবিত্ত শিক্ষিত সমাজ। পরে মধ্যবর্গ মধ্যবর্ণ এগোল। এখন ভারতবর্ষে এগোচ্ছে দলিত হিন্দু। কিন্তু অনগ্রসর মুসলমান ‘ফৌত’ হচ্ছে দিনকে দিন।
ভারতবর্ষে মুসলমান মধ্যবিত্ত গড়ে ওঠার কোনো সুদূর সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে না। মুসলমানের জন্য অর্থাত্ ভারতীয় মুসলমানের জন্য কোনো রেনেসাঁস অপেক্ষা করে নেই।
কিন্তু বাংলাদেশের মুসলমান জীবনে রেনেসাঁ হয়েছে সীমাবদ্ধ আকারে হলেও হয়েছে। খুব শক্তিশালী মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে না উঠলেও একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি গড়ে উঠেছে।
এই ব্যাপারটি এই মুক্তবুদ্ধির আন্দোলন ‘শিখা’ পত্রিকাগোষ্ঠীকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল, গড়ে উঠেছিল মুসলমান রায়তের টাকায় গড়ে ওঠা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হওয়ার প্রেক্ষাপটে। এ নিয়ে বাংলাদেশে বৃহত্-চর্চা হয়েছে। আমি আর সে কথায় যাব না।
বাংলাদেশের রেনেসাঁস শুধু মুসলমানের রেনেসাঁস নয়, ভাষা সংস্কৃতি রেনেসাঁস সেখানে হিন্দুু সমাজেরও নবজাগরণ বটে। হিন্দুু জীবনে সেই ভাষা জাগরণের মহত্ দীপ্তি আসুক আমি চাই।
খোলা মনে বিচার করুন পাঠক, কোন রেনেসাঁসের চরিত্র ঠিক কী? একটির উদ্দীপক শক্তি ভাষা। অন্যটি ধর্ম সংস্কারমূলক সংবেদনা। নারীশিক্ষা, ব্যক্তি স্বাধীনতা এই সংবেদনার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে সত্য, কিন্তু মুখ্য আন্দোলন বিধবা বিবাহ প্রত্যক্ষত সেটাই হয়েছে রেনেসাঁসের এজেন্ডা।
শরত্চন্দ্র কী চোখে দেখছিলেন এই বিধবা বিবাহ, তারই ভাষায় পেশ করা যাক—
‘মানুষ তার সংস্কার ভাব নিয়েই ত মানুষ; ... সংস্কার ও ভাবের বিরুদ্ধে সৌন্দর্য সৃষ্টি করা যায় না,... একটা দৃষ্টান্ত দিয়ে বলি। বিধবা বিবাহ মন্দ, হিন্দুর ইহা মজ্জাগত সংস্কার। গল্প বা উপন্যাসের মধ্যে বিধবা নায়িকার পুনর্বিবাহ দিয়ে কোনো সাহিত্যিকেরই সাধ্য নাই, নিষ্ঠাবান হিন্দুর চক্ষে সৌন্দর্য সৃষ্টি করবার। পড়বামাত্রই মন তার তিক্ত বিষাক্ত হয়ে উঠবে। গ্রন্থের অন্যান্য সমস্ত গুণই তার কাছে ব্যর্থ হয়ে যাবে। স্বর্গীয় বিদ্যাসাগর মহাশয় যখন গভর্নমেন্টের সাহায্যে বিধবা বিবাহ বিধিবদ্ধ করেছিলেন, তখন তিনি কেবল শাস্ত্রীয় বিচারই করেছিলেন, হিন্দুর মনের বিচার করেননি। তাই আইন পাস হলো বটে, কিন্তু হিন্দু সমাজ তাকে গ্রহণ করতেই পারলে না। তার অতবড় চেষ্টা নিষ্ফল হয়ে গেল। নিন্দা গ্লানি, নির্যাতন তাকে অনেক সইতে হয়েছিল, কিন্তু তখনকার দিনের কোনো সাহিত্যসেবীই তার পক্ষ অবলম্বন করলেন না। হয়ত এই অভিনব ভাবের সঙ্গে তাদের সত্যই সহানুভূতি ছিল না, হয়ত তাদের সামাজিক অপ্রিয়তার অত্যন্ত ভয় ছিল, যে জন্যই হোক, সেদিনের সে ভাবধারা সেইখানেই রুদ্ধ হয়ে রইল। সমাজদেহের স্তরে স্তরে গৃহস্থের অন্তঃপুরে সঞ্চারিত হতে পেলে না। কিন্তু এমন যদি না হত এমন উদাসীন হয়ে যদি তারা না থাকতেন, নিন্দা, গ্লানি, নির্যাতন—সকলই তাঁদিগকে সইতে হত সত্য, কিন্তু আজ হয়ত আমরা হিন্দুর সামাজিক ব্যবস্থার আর একটা চেহারা দেখতে পেতাম। সেদিনের হিন্দুর চক্ষে যে সৌন্দর্য-সৃষ্টি কদর্য নিষ্ঠুর ও মিথ্যা প্রতিভাত হত, আজ অর্ধ শতাব্দী পরে তারই রূপে হয়ত আমাদের নয়ন ও মন মুগ্ধ হয়ে যেত।’ [শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় / স্বদেশ ও সাহিত্য]
এটাই রেনেসাঁসের কণ্ঠস্বর। কিন্তু এই রেনেসাঁস তো হিন্দু সমাজের সর্বাংশের রেনেসাঁস নয়। হিন্দুর বর্ণবাদকে বিদ্যাসাগর অতিক্রম করতে পারেননি। ফলে বর্ণবাদ সুরক্ষিতই থেকে গেছে।
আমার মূল্যায়ন এ রকম—পাকিস্তানে মুসলমান একটি জাতি। বাংলাদেশে মুসলমান একটি সম্প্রদায়। ভারতবর্ষে মুসলমান একটি বর্ণ মাত্র—নিম্নবর্ণ। কারণ মুসলমান এখানে নিম্নবর্ণ থেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছে। নিম্নবর্ণ থেকে বৌদ্ধ হয়ে তারপর মুসলমান হয়েছে—এমনও হয়েছে। বাংলাদেশে তার নিম্নবর্ণত্ব ঘুচে গেছে ভাষাজাতি হিসেবে নিম্নসত্তার ধর্মনিরপেক্ষ উত্তরণে; সে হয়ে উঠেছে যথার্থ বাঙালি, তার সঙ্গে মিশে আছে হিন্দু সম্প্রদায়েরও সমান উত্তরণ; ভাষা-প্রত্যয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য জাগরণ (রেনেসাঁস)। এ জিনিস ভারতবর্ষে লক্ষ লক্ষ বছরেও হবে না কারো—কোনো বর্ণ বা সম্প্রদায়ের—দলিতের বা মুসলমানের। ভারতবর্ষে যথার্থ রেনেসাঁস আসতে হলেও বর্ণবাদের অনড় জগদ্দল সরাতে হবে—এ কাজে কোনো কারো স্পৃহা দেখা যায় না।
অথচ ভারতবর্ষে অন্য চর্চাও তো ছিল; ধর্ম-সমন্বয়ের এক দীর্ঘ ঐতিহ্য তো ছিল; বাঙালি হিন্দুর মুখে বহুত্ববাদের গালভরা মননশীল চমক ছিল, ধর্মবেত্তা ঠাকুরের মুখে ছিল ‘যত মত তত পথ’—বাণী। সবকে চমকে দিয়েছে নতুন এক হিন্দুযুগ শুরু হয়েছে ভারতবর্ষে। বল্লাল সেনের হিন্দুত্ব এই সুপ্রাচীন নবত্বে ভরা হিন্দুত্বের কাছে নস্যি মাত্র।
অথচ হিন্দু ও মুসলমান এখনও আমরা একসঙ্গে রয়েছি। যদিও ভারতের মুসলমান প্রকৃত প্রস্তাবে আদিবাসীদের চেয়েও গরিব, অসহায়, নিরাপত্তাহীন।
আমি একজন নিম্নবর্ণেরই লোক। আমার দাদা সাহেব (ঠাকুরদা)’র নাম সুবরাতি মন্ডল। তার বাবার নাম গোলাপ মন্ডল। আমার বাবার নাম কলিমউদ্দিন আহমেদ (মন্ডল)। আমার পদবি আসলে মন্ডল; নিম্নবর্ণের মন্ডল। ভারতবর্ষে মুসলমানের চাকরি (সরকারি) তিন শতাংশেরও কম। পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ শতাংশ—উচ্চপদে কোনো চাকরি নেই। রেলে চার শতাংশ—অত্যন্ত নীচু পদে নিযুক্ত।
মোদীভাই কলকাতার জনসভায় প্রকাশ্যেই বলে গেছেন, যারা দুর্গাপূর্জা করেন সেই সব হিন্দুর জন্য ভারতের দরজা উন্মুক্ত রয়েছে।
কিন্তু ভারতবর্ষে, বিশেষ এই বাংলায় মুসলমানের উদ্যোগেও তো দুর্গাপূজা হয়। মুর্শিদাবাদের লোক আমি, সেখানে পূজা কমিটির সম্পাদক-সভাপতি মুসলমান; কলকাতায় নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম একাই একটি দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। দিন পনের আগে খুঁটি পূজা হলো এক জায়গায়, এই কলকাতার বুকে—উদ্বোধক ফিরহাদ; তত্সহ আমিও ছিলাম। আমার লেখা ‘জমিজিরেত’ নামে একটি ছোটগল্প প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ-তে পাঠ্য—তার নায়ক একজন শিব-উপাসক মুসলমান—কাশ্মিরের যে ইসলাম, তা আসলে শৈব ইসলাম। আমরা শিব-কৃষ্ণের উপাদান ইসলামে নিয়েছি। তবু ভারতে জায়গা হচ্ছে না কেন? কোন রেনেসাঁস হলে এদেশে মুসলমান বাঁচে, আনিসুজ্জামান কি বলতে পারেন?

লেখক :ভারতের প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক
http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/sub-editorial/2017/08/04/213759.html#disqus_thread

ভারতের মুসলমান

তবু ভারতে জায়গা হচ্ছে না কেন? কোন রেনেসাঁস হলে এদেশে মুসলমান বাঁচে, আনিসুজ্জামান কি বলতে পারেন?


৪ আগস্ট বাংলাদেশের ইত্তেফাকে একটি উপসম্পাদকীয় ছাপা হয়েছে। যার লেখক ভারতের প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক আবুল বাশার। এই লেখায় এমন কিছু বেদনা আমরা লক্ষ্য করি যা চিন্তাশীল মানুষের জন্য ভাবনার বিষয় বটে! তিনি বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী আনিসুজ্জামানের কাছে একটা ছোট্ট প্রশ্ন রেখেছেন সর্বশেষে। পাঠক আপনারাও লেখাটা পড়ে দেখতে পারেন। আমি আগের পোস্টে শেয়ার করেছি। এখানে চুম্বক অংশ তুলে ধরলাম।... আমার মূল্যায়ন এ রকম—পাকিস্তানে মুসলমান একটি জাতি। বাংলাদেশে মুসলমান একটি সম্প্রদায়। ভারতবর্ষে মুসলমান একটি বর্ণ মাত্র—নিম্নবর্ণ। কারণ মুসলমান এখানে নিম্নবর্ণ থেকেই ধর্মান্তরিত হয়েছে। নিম্নবর্ণ থেকে বৌদ্ধ হয়ে তারপর মুসলমান হয়েছে—এমনও হয়েছে। বাংলাদেশে তার নিম্নবর্ণত্ব ঘুচে গেছে ভাষাজাতি হিসেবে নিম্নসত্তার ধর্মনিরপেক্ষ উত্তরণে; সে হয়ে উঠেছে যথার্থ বাঙালি, তার সঙ্গে মিশে আছে হিন্দু সম্প্রদায়েরও সমান উত্তরণ; ভাষা-প্রত্যয়ে আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য জাগরণ (রেনেসাঁস)। এ জিনিস ভারতবর্ষে লক্ষ লক্ষ বছরেও হবে না কারো—কোনো বর্ণ বা সম্প্রদায়ের—দলিতের বা মুসলমানের। ভারতবর্ষে যথার্থ রেনেসাঁস আসতে হলেও বর্ণবাদের অনড় জগদ্দল সরাতে হবে—এ কাজে কোনো কারো স্পৃহা দেখা যায় না।
অথচ ভারতবর্ষে অন্য চর্চাও তো ছিল; ধর্ম-সমন্বয়ের এক দীর্ঘ ঐতিহ্য তো ছিল; বাঙালি হিন্দুর মুখে বহুত্ববাদের গালভরা মননশীল চমক ছিল, ধর্মবেত্তা ঠাকুরের মুখে ছিল ‘যত মত তত পথ’—বাণী। সবকে চমকে দিয়েছে নতুন এক হিন্দুযুগ শুরু হয়েছে ভারতবর্ষে। বল্লাল সেনের হিন্দুত্ব এই সুপ্রাচীন নবত্বে ভরা হিন্দুত্বের কাছে নস্যি মাত্র।
অথচ হিন্দু ও মুসলমান এখনও আমরা একসঙ্গে রয়েছি। যদিও ভারতের মুসলমান প্রকৃত প্রস্তাবে আদিবাসীদের চেয়েও গরিব, অসহায়, নিরাপত্তাহীন।
আমি একজন নিম্নবর্ণেরই লোক। আমার দাদা সাহেব (ঠাকুরদা)’র নাম সুবরাতি মন্ডল। তার বাবার নাম গোলাপ মন্ডল। আমার বাবার নাম কলিমউদ্দিন আহমেদ (মন্ডল)। আমার পদবি আসলে মন্ডল; নিম্নবর্ণের মন্ডল। ভারতবর্ষে মুসলমানের চাকরি (সরকারি) তিন শতাংশেরও কম। পশ্চিমবঙ্গে পাঁচ শতাংশ—উচ্চপদে কোনো চাকরি নেই। রেলে চার শতাংশ—অত্যন্ত নীচু পদে নিযুক্ত।
মোদীভাই কলকাতার জনসভায় প্রকাশ্যেই বলে গেছেন, যারা দুর্গাপূর্জা করেন সেই সব হিন্দুর জন্য ভারতের দরজা উন্মুক্ত রয়েছে।
কিন্তু ভারতবর্ষে, বিশেষ এই বাংলায় মুসলমানের উদ্যোগেও তো দুর্গাপূজা হয়। মুর্শিদাবাদের লোক আমি, সেখানে পূজা কমিটির সম্পাদক-সভাপতি মুসলমান; কলকাতায় নগরোন্নয়ন মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম একাই একটি দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। দিন পনের আগে খুঁটি পূজা হলো এক জায়গায়, এই কলকাতার বুকে—উদ্বোধক ফিরহাদ; তত্সহ আমিও ছিলাম। আমার লেখা ‘জমিজিরেত’ নামে একটি ছোটগল্প প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএ-তে পাঠ্য—তার নায়ক একজন শিব-উপাসক মুসলমান—কাশ্মিরের যে ইসলাম, তা আসলে শৈব ইসলাম। আমরা শিব-কৃষ্ণের উপাদান ইসলামে নিয়েছি। তবু ভারতে জায়গা হচ্ছে না কেন? কোন রেনেসাঁস হলে এদেশে মুসলমান বাঁচে, আনিসুজ্জামান কি বলতে পারেন?
কপি: Mohiuddin Mohammad

chirograph

the chirograph

the chirograph
the chirograph
the chirograph
the chirograph
the chirograph
the chirograph
the chirograph
the chirograph
the chirograph